বরিশাল সিটি ছাড়তে চায় বাসিন্দারা

বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ‘ছিটমহল’ চর জাগুয়া। বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। যেখানে প্রায় প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস। এই সকল মানুষের যোগাযোগের জন্য সরু একটি সড়ক থাকলেও তা এখন চলাফেরা অযোগ্য। এছাড়াও ওই এলাকার মানুষের যাতায়াতের জন্য একটি ট্রলার থাকলেও তা একটি সিন্ডিকেট ইচ্ছেমত পরিচালনা করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানে বসবাসকৃত মানুষের দুর্ভোগের আর শেষ নেই। এই সকল ব্যাপারে দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদকের কথা হয়েছে সিট মহলের চর জাগুয়া বাসিন্দাদের সঙ্গে।
এই এলাকার প্রায় ৫০০ মানুষের জন্য সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা একটি মাত্র ট্রলার। এলাকাটি সিটির আওয়াতায় থাকলেও নেই ইন্টারনেট, ময়লা অপসারণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। এখানকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে বর্ষার দিনে মাছ ধরা এবং চাষাবাদ করা।
স্থানীয় বাসিন্দা দিনমজুর মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের যে ছিটমহলগুলো আছে, সেই অবস্থায় আমাদেরটাও। চারদিকে নদী। এখান থেকে বের হবার জন্য শুধুমাত্র একটি রাস্তা। তবে বরিশাল শহরের মতো কোনো আমেজ নেই।’
স্থানীয় বাসিন্দা গৃহিনী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আছি খয়রাইত্তা এলাকায়। সিটির মধ্যে থাইক্কাও অবহেলিত। আমাগো রাস্তায় কারেন্ট আছে; খাম্বায় বাল্ব নাই। সিটি করপোরেশন পানির বিল, কারেন্ট বিল, সবকিছুই আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের কলে পানি উঠে না। আমরা খালের পানি ফিটকিরি দিয়া খাই। এতে সব সময় আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি লেগেই থাকে। এছাড়া এই অঞ্চলে কোনো স্বাস্থ্যসেবা বা হাসপাতাল নেই। কোনো রোগী অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সবাইকে। রাতে টর্চ লাইট নিয়ে বাইরে বের হতে হয়। সন্ধ্যা নামলেই এলাকা ভূতুরে হয়ে যায়। আমরা অনেক কষ্টে আছি। বিভিন্ন সময়ে সহায়তা দিবে শুনি; কিন্তু গত পাঁচ বছরে এক সের চাউলও পাই নাই। আর পাঁচ বছর আগে এসে ভোট চেয়ে গেছে। আমাগো উন্নয়ন করবে। কিন্তু কিছুই করে নাই। নির্বাচিত হওয়ার পরে তাদের চেহারাও আমরা দেখি নাই। এছাড়াও ওই এলাকায় মশা মারার ঔষধও দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর হইয়া গেছে। কোনো খবর নাই। ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ ঝুইলায়া খায়।’
সিটিতে বাস করে কোনো সুযোগ-সুবিধা একদমই নেই বলে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষিকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সিটির মধ্যে অন্যান্য ওয়ার্ডে কত সাহায্য সহায়তা দেওয়া হয় কিন্তু আমরা সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ গত পাঁচ বছর আগে এখানে এসেছিলেন। নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে পাঁচ বছরে তার মুখ দেখা যায়নি।’ তবে স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি আরো বলেন, ‘কাউন্সিলরের সাথে দেখা হলে সালাম পর্যন্ত নেয় না। এছাড়াও স্থানীয় মানুষ যদি কোন বিপদ আপদে পড়ে তিনি এগিয়ে আসেন না। অনেক সরকারি সহায়তা; রেশন এসব দিয়েও তিনি স্থানীয় নাগরিকদের সাহায্য সহায়তা কখনোই করেননি।’
এলাকায় ভোট চাইতে কেউ আসে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এবার ভোট চাওয়ার জন্য সাবাই লাইন দিচ্ছে। কিন্তু আর ভোট দিয়া কি হইবে? হেগো মতো হেরা মাতুব্বর বানাইবে। আমরা এই সিটির মানচিত্র দিয়ে আলাদা হইতে চাই। দরকার নাই সিটি করপোরেশন। আর যদি আমাদের সিটি মধ্যে রাখতেই হয় তাহলে চলাচলের জন্য সড়ক এবং একটি ব্রিজসহ সিটি করপোরেশনের যত সুযোগ সুবিধা আছে তা সব কিছু প্রদান করতে হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও সমাজকর্মী মো. কবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে ভোট কেন্দ্র নেই। আমরা ভোট দিতে যাই কালিজিরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় আমাদের ওই কেন্দ্রে নদী সাঁতরে ভোট দিতে যেতে হয়। অর্থাৎ গেলো নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে দেখি আমার ভোট আগে থেকেই হয়ে গেছে অথচ আমি কিছুই জানি না।’
স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক মো. পারভেজ বলেন, ‘আমরা সিটিতে বসবাস করায় পাঁচ শতাংশ জমিতে ট্যাক্স দিতে হয় ৫০ টাকা। অথচ ইউনিয়ন পর্যায় এই পরিমাণ জমিতে ট্যাক্স দিতে হয় ৭ থেকে ৮ টাকা। কিন্তু আমরা এখানে সকল নাগরিক সিটি করপোরেশনের সুযোগ সুবিধা থেকে একদমই বঞ্চিত। এই যে এক অসহনীয় বোঝা; এটি আমাদের বহন করতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যে জমি- এই জমিতে যেই ফসল চাষ হয় তা বিক্রি করেও এত এত খরচ সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বাজারে প্রতিদিন একটি লেবারের খরচ ৭০০ টাকা। এখানে এক একর জমি চাষ করতে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে খাজনা দিতে গেলে দেখা যায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়। তাইলে আমরা কি পাই বছরে?
এলাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় হলেও সেখান থেকে কোনো বিদ্যুতের লাইন এখানে দেওয়া হয়নি। এমন মন্তব্য করে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আমাদের এলাকাটি সিটি করপোরেশনের আওতায়। এলাকায় বিদ্যুতের খাম্বা বসানো হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন থেকে কোন বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। পাশের এলাকা নলছিটি থেকে আমাদের এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।’
তবে এখানে শিক্ষার হার অনেক অংশে কম। এছাড়াও যারা মোটামুটি শিক্ষিত তারা এলাকা ছেড়ে শহরে বসবাস করছেন বলে জানান চর জাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গত ১৫ বছর আগে শওকাত হোসেন হিরন যখন বরিশালের মেয়র ছিলেন তখন এই ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন আমার স্ত্রী। ওই সময় এলাকাটির উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু কাজ আমরা করতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে মেয়র ছিলন বিএনপির; সে সময় কোনো উন্নয়ন হয়নি। কিন্তু বতর্মানে আমি কাউন্সিলর হলেও ব্যর্থ। কারণ আমাদের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্ল্হ; বরিশালের মানুষ যখন ঘুমাতে যায় তখন তিনি সজাগ হয়। আর মানুষ যখন সজাগ হয় তখন তিনি তখন ঘুমাতে যায়। আমরা কাউন্সিলর হিসেবে ওনার দেখা খুব কমই পাইতাম। ১৫-২০ দিন ঘুরে ওনার দেখা পাওয়া যেত। তাই কাউন্সিলর’ই ওনার দেখা পাই তো না; তবে জনগণ কি উপকার পাবে?