বিশ্ব মানবতার কবি নজরুল

আজ ২৫ মে বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ। মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪ তম জন্ম বার্ষিকী। কবির প্রতি আমাদের পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আজ সারা দেশে ব্যাপকভাবে না হলেও কবির জন্মদিন পালন হবে অনেক স্থান। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেষ ঠিকানা (সমাধিস্থল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও জন্মজয়ন্তী পালন করবে। আড়ম্বরপূর্ণ কিংবা আড়ম্বরহীন হলে দোষের কিছু নেই। শ্রদ্ধাবোধ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারলেই কবির জন্মদিন স্বার্থক হয়। অনেক আলোচনায় কাজী নজরুলকে খ-িতভাবে উপস্থান করা হয়। যারা এই কাজটি করেন তারা জেনে বুঝেই করেন। ফলে নতুন প্রজন্ম পূর্ণাঙ্গ নজরুলের ছবি দেখতে পায় না। নজরুরের সাহিত্যে কাঁচি চালিয়ে উপস্থাপনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেউ তাঁকে মুসলমান, কেউ হিন্দু আবার কেউ নাস্তিক উপাধি দিয়ে মূল্যায়ন করতে ছাড়েন না। এরকম স্থূল দৃষ্টি দিয়ে কবির জন্মদিন পালন করলে সেটা অবশ্যই দোষের। কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে কবিকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা বন্ধ হওয়া উচিত।
কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। বাস্তবে আমরা জেগে আছি না ঘুমিয়ে আছি সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। আমরা কি দেশ মাকে এমন কথা আর বলতে পারবো না? আমরা যদি এইভাবে সব দেখে শুনেও চোখ বন্ধ করে থাকি, তাহলে কি সত্যিকার রাত পোহাবে? নজরুল যে কোন বিশেষ ধর্মের বা গোত্রের ছিলেন না, তা তার গল্প, কবিতা, উপন্যাসে ষ্পষ্ট। তারপরও তাকে নিয়ে টানাটানি কেন? আমাদের সামনের আঁধার দূর করতে হলে নজরুলকে নিয়ে টানাটানি বন্ধ করতে হবে। নজরুল ইসলামকে তাঁর দর্শন ও চিন্তার জায়গায় রাখতে হবে।
নজরুলের বয়স যখন ২২-২৩ বছর তখন থেকেই তঁকে নিয়ে এই টানাটানি শুরু। ১৯২২ সালে কবি লিখলেন,
বল বীর
আমি চির উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারই নত শির
ওই শিখর হিমাদ্রীর
বল মহাবিশে^র মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভ্যুলোক দ্যুালোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরস ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির বিস্ময়
আমি বিশ^ বিধাত্রির।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর নজরুলকে নিয়ে টানাটানির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। আখ্যা দেয়া হয় নাস্তিক। কিন্তু একই কবিতায় কবি লিখেছেন,
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত
যবে উৎপ্রীতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাপারীর খড়র্গ কৃপান
ভীম রণভূমে রণিবে না।
এই অমোঘ বাণি বুঝলেও সেটা ধারণ কিংবা লালন করেনি। তাদেও ভাষায় নাস্তিককবি যখন শ্যামা সঙ্গীত লিখে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন, তখন তাকে হিন্দুর কবি বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই দায় কিছুটা ঘুচে যায়, কবির ইসলামী গান এবং হামদ-নাথ লেখার কারণে। কিন্তু ধর্মীয় টানাটানি বন্ধ হয়নি। মুসলমানরা কেবল কবির ইসলামী গান ও হামদ-নাথের ওপর দাঁড়িয়ে কবিকে নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা তাঁর শ্যামা সঙ্গীতের ওপর ভর করে কবিকে সামনে নিয়ে যেতে চান। এই দুটোই চরম অপরাধ।
কবি এ দুটোর কোন একটি গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের নয়। কবি গোটা দুনিয়ার মানুষের জীবনবোধ ও দর্শন নিয়ে আজন্ম লিখে গেছেন। তিনি কখনো হিন্দু-মুলমানকে পৃথকভাবে দেখেননি। তাই তিনি খিখেছেন ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ।’ কবির এই গানে আমরা মুগ্ধ হতে পারছি না। আমরা ব্যস্ত কবিকে হিন্দু-মুসলমানের দুই ধারায় ভাগ করার কাজে। তাই তো কবির লেখা কবিতার শব্দও বদল করি ধর্মীয় চিন্তা থেকে। (মহাশ্মশান পরিবর্তন করে গোরস্থান) বানিয়ে দিচ্ছি। এই কাজ করে আমরা আনন্দিত হই। কবি নজরুল যে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট গালাগালিকে গলাগলিতে রূপ দিতে চেয়েছিলেন, সেই দর্শন ও চিন্তার কথা মনে রাখছি না। এভাবে নজরুলকে খন্ডিত উপস্থাপন করলে আমাদের জাতীয় কবি সম্পর্কে আমাদের প্রজন্ম কি শিখবে।
গোটা দেশে কবির অসাম্প্রদয়িক চিন্তাকে নিয়ে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা দরকার। এব্যাপারে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিতে পারে। আমরা চাই সংস্কৃতিবান্ধব সরকার কবি নজরুলের সামগ্রিক সৃষ্টি সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হবেন।