নজরুলকাব্যে প্রেম ভাবনা

দেবাশীষ হালদার : বিশ শতকের সংকটক্ষুব্ধ কালসীমায় কবি নজরুল ইসলাম চেতনোয় বয়ে এনেছেন মুক্তির অগ্নিমন্ত্র ও বিদ্রোহতেজ; আর সুরের ধারায় ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রেমের অলকানন্দা। তাঁর কবিতায় একদিকে রয়েছে বিদ্রোহের উচ্চাকিত বাণীমূর্ছনা; অন্যদিকে সমকালবদ্ধ পরাধীনতায় বন্দী দুঃখপীড়িত মানুষের জন্য নিবিড় অনুরাগ। চৈতন্যের বহুমাত্রিক অভিক্ষেপই কবি নজরুলকে করেছে যুগন্ধর শিল্পীসত্তা। ফলে পরাধীনতা, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিপরীতে তিনি বাজালেন ‘অগ্নিবীণা’। আবার, রিক্ত-বঞ্চিত-সর্বহারার জন্য রোমাণ্টিক বেদনা-বেহাগে শোনালেন বাঁশরির সুর। কবি নজরুল তাই শুক্লপক্ষের ব্রতধারী এবং প্রেম ও বিদ্রোহভাবের অনন্য রূপস্রষ্টা কবি।
পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতায় ক্ষুব্ধতা
কবি নজরুলের মানসভাবনায় প্রোথিত আবেগ, কর্মপ্রেরণা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, সাধ ও সাধনা সমস্ত কিছুকে জুড়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রোমাণ্টিক অনুভাবনা। তাই সংগ্রাম ও প্রেম তার কবিসত্তার দুটি মৌল অনুষঙ্গ মাত্র। কাজী নজরুলের মনোচেতনায় যে প্রতিজ্ঞা নিহিত ছিল, তা সকল বৈরিতাকে বিনাশ করে মানব সমাজের শ্রেয়োতর বিন্যাস ও সংকল্প পূরণের জন্য তিনি বিদ্রোহ করেছেন প্রথা, বৈষম্য এবং সকল অসংগতির বিরুদ্ধে। কবি নজরুলের সংগ্রামী চেতনার প্রসারতা ও প্রেমারতি তার কবিতায় উজ্জ্বল রূপায়ণে চিহ্নিত।
বাংলা কবিতায় কবি নজরুলের সদম্ভ প্রবেশ ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। স্বাতন্ত্র্য ধন্য এ কাব্যে কবি নজরুলের দ্বিখন্ডিত কবিসত্তার প্রথম অংশের কিরণ প্রতিফলিত। ‘আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখীর’-এ উচ্চারণে কবির অদম্য আবেগ মুক্তমানবত্মার দিগি¦জয়ী অভিলাষকে বিজ্ঞাপিত করেছে। অন্যদিকে কবির অমিতবিক্রম প্রবৃত্তির স্নিগ্ধ কিরণ ‘প্রেম’ কে ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যে মহিমান্বিত রূপে অভিষিক্ত করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাঝেই পরম প্রার্থিত বেদনাস্্রাবী প্রেমের লাজনম্র উপস্থাপন ঘটেছে এভাবে-
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি; ছল করে দেখা অনুখন;
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা; তাঁর কাঁকন চুড়ির কন্ কন্
আমি চিরশিশু চির কিশোর
আমি যৌবন ভীতু পল্লীবেলার আঁচর কাঁচলি নিচোর।
পড়ুন: অসাম্প্রদায়িক নজরুল ও আমাদের বোধ
কবির প্রেমিক সত্তার যথার্থ ছবিটি এখানে স্ফুট। তার প্রেমারতির নম্র উচ্ছ্বাস কেবল ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যে নয়, বরং সমগোত্রীয় কাব্যসমূহ ‘ছায়ানট’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’, ‘চক্রবাক’, ‘চোখের চাতক’, সহ অজস্র প্রেমসঙ্গীতে পরিস্ফুট। বাঙালি জনচিত্তের দুঃখ, পরাজয়, বেদনা ও দীর্ঘশ্বাস সহ কবির ব্যথিত চিত্তের হাহাকার, অশ্রুসিক্ত অভিমান, ব্যর্থ প্রেম ও সেই বেদনা বিলাসকে কবি মর্মদ্রাবী ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কবি নজরুলের ‘বিষের বাঁশী’র সুরধারাই যেন প্রেমের ক্ষেত্রে নবতর ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। তাঁর কাব্যে যে প্রবল অহংচেতনা ও দ্রোহের প্রকাশ ঘটেছিল, তারই পাশে প্রেমের বিনম্র ও স্নিগ্ধ আরতি-
এই যে তোমার অবহেলা,
তাই নিয়ে মোর কাট্বে বেলা,
হেলা ফেলার বসবে মেলা
একলা আমার বুকের মাঝে
সুখে দুখে সকল কাজে।
এখানে প্রেমের পূর্ণতা যুগল মিলনে না খুঁজে, ব্যর্থতা-বিষন্নতা-যন্ত্রনা ও বিষাদের আরকে জীবন ভরিয়ে তোলাতেই যেন প্রেমের চরিতার্থতা। মধ্যযুগীয় প্রেমভাবনায় উচ্চাকিত কবিসত্তা প্রেমাস্পদের অঙ্গুলিহেলনে যেন জীবন দিতে পারেন। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যের ‘বেলাশেষে’ কবিতায় কবির মর্মদহনের আলিম্পন পড়েছে এভাবে-
আমার এ ক্লীষ্ট ভালবাসা
তাই বুঝি হেন সর্বনাশা।
প্রেয়সীর কণ্ঠে কভু এই ভুজ, এই বাহু জড়াবেনা আর
উপেক্ষিত আমার এ ভালবাসা মালা নয়, খর তরবার।- এই সর্বনাশা ভালবাসার
খর তরবারে প্রেয়সী নয়; কবি নিজেকেই আহুতি দিতে যেন প্রস্তুত। বিরহ তাপিত কবিসত্তা অচরিতার্থ বাসনার জন্য যে আকুতি জানিয়েছে তাতে স্বপ্নভূক কবি নজরুলের প্রেমভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। নজরুলের আপনভোলা ভাবনার স্বলিপিতে প্রেমের যে সুরধারা উচ্ছ্বসিত তাতে ধ্বনিত হয়েছে হৃদয়াবেগের অমলিন মূর্ছনা। ‘দোলন চাঁপা’র ‘সমর্পণ’ কবিতায় চিরজনমের প্রিয়ার কাছে কবির অকৃপণ অঞ্জলি-
আপন মালা পরাও বালা পড়াও আমার গলে,
এবার আমায় সঁপে দিলাম তোমার চরণ তলে।
কবি নজরুলের প্রেমচেতনা কেবল বাসনাবিদ্ধ আবেগকাতর অস্তিত্বের বিলাপ নয়; বরং তা রিক্ত কবিসত্তার সঙ্গপিয়াসী মরমের বার্তাবাহী। নিছক জৈব বাসনার ইন্ধনে নজরুলের বাসনাবহ্নি ফুটে ওঠেনি; তবে অনামা প্রিয়ার প্রতি তার নিবেদন শেফালির স্মিতহাসি ও মধুসৌরভে প্রসাধিত। ‘পূজারিণী’ কবিতায় কবির প্রেমারতির অকুণ্ঠ উচ্চারণ-
প্রেমের সকল আশ, সব প্রেম ভালবাসা দিয়া
তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বেদরদী পূজারিণী প্রিয়া,
ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই, তুমি নেবে তার ভার হেসে,
বিশ^বিদ্রোহীরে তুমি করবে শাসন
অবহেলে শুধু ভালবেসে।
কবি নজরুলের প্রেমভাবনায় দুরন্ত অনুরাগের ঘূর্ণি বার বার দোলা দিয়েছে। ভালবাসা তার জীবনে বেদনার করুণতম রঙ মেখে দিয়ে নীল নির্জনের বিষণ্নতা ছড়িয়ে দিয়েছে। কবির অনেক কবিতাই যেন অভিমান ক্ষুব্ধ রোরূদ্যমান চিত্তের উচ্ছ্বাস-
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে;
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
কবি নজরুল প্রেমের অভিমানী ও উদ্বেগদীর্ণ। কবি ভালোবাসার পরশপাথর ছুঁয়েই যেন কবি হয়ে উঠেছেন। স্মৃতির সকল প্রান্ত, আকাশ-আলো-বনতল-সন্ধ্যাতারা সবখানে ফুটে উঠল ভালবাসার অমলিন আভা, যা ‘কবি বাণী’ কবিতায় নিবিড় অনুরাগে উৎসারিত-
তুমি আমায় ভালবাস তাইতো আমি কবি,
আমার এ রূপ সে যে তোমার ভালবাসার ছবি।
মৃত্যুর ছায়া প্রসারিত পৃথিবীতে কবি প্রেমকেই দেখেছেন ধ্রুবতারার মতো। দয়িতাই যেন তার খণ্ডজীবনের সীমানা পার হয়ে অনন্ত জীবনের সঙ্গী হয়,- এই তার আকুতি। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যের ‘শেষ প্রার্থনা’ কবিতায় চোখের জলের ভাষায় সেই অনুরাগ দ্যুতিময়-
আজ চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বরষের শেষে,
যেন এমনি কাটে আসছে জনম, তোমায় ভালবেসে।
নজরুল কাব্যে প্রেমচেতনা কেবল রূপরাগে চঞ্চল অস্তিত্বের জীবনোল্লাসের তরঙ্গভঙ্গ নয়। কবি সাম্যের জয়গান গেয়ে হয়ে উঠেছেন শোষিত মানবাত্মার স্বপ্নদ্রষ্টা অভিযাত্রিক। নজরুলের বিদ্রোহচেতনার উৎসমূলে রয়েছে মানবপ্রেম। মানবাত্মার মুক্তি ও মানবতার প্রতিষ্ঠাকল্পে তার ক্ষুরধার বাণী মানবমহিমাকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
আমার রক্তলেখায় যেন লেখা হয় তাদের সর্বনাশ।
সমাজ, রাজনীতি, লোকজীবন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কবি নজরুল সঙ্গতির সাধক। তবে নারীর মর্যাদা ও তার জাগরণ যেমন তিনি কামনা করেছেন; তেমনি আপন অন্তরের অভিবাদনও জ্ঞাপন করেছেন গভীর বিশ্বাসে। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যে যোজিত এ সুর ‘ছায়ানট’ কাব্যে অধিকতর পরিস্ফুট। কল্পনামাধুর্যে, নিসর্গসম্ভোগে ও প্রেমের অন্তরঙ্গ আলাপনে ‘ছায়ানট’ কাব্য অনেক পরিণত কাব্য। দেহবদ্ধ কামনার উচ্ছ্বাস সরিয়ে কবি নজরুল দেহাতীতের জন্য যে আর্তি ধারণ করেছেন তার প্রকাশ মেলে তার কাব্যে। ‘বিজয়িনী’ কবিতায় সেই অনুপম রূপবন্ধ-
হে মোর রাণি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।
কবি নজরুলের প্রেমভাবনায় বিরহই সত্য। মিলনের মাঝেও তার বিরহতৃষ্ণার যেন অবসান হয় না। বৈষ্ণব সাহিত্যে যেমন রয়েছে ‘দুহু কোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’- এই বার্তা নজরুলের কাব্যে অনন্ত পিপাসার প্রতীক চিহ্নিত। ‘চিরজনমের প্রিয়া’ কবিতায় সেই বাণী প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-
কহিলাম যত কথা প্রিয়তমা মনে কর সব মায়া
সাহারা মরুর বুকে ঝরেনাগো শীতল মেঘের ছায়া।
পার্থিব প্রেমের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে কবি পরমতম সেই নিত্যের সাথে আপন সত্তার নিবিড় বন্ধন অনুভব করেছেন। এই প্রেমবন্ধন পরমস্রষ্টার লীলারই যেন অংশ-
আমরা সকলে খেলি তারই সাথে; তারই সাথে হাসি কাঁদি
তার ইঙ্গিতে ‘পরম আমি’রে শত বন্ধনে বাঁধি।
মোরে আমি ভেবে তারে ‘স্বামী’ বলি দিবাযামী নামি উঠি
কভু দেখি আমি তুমি যে অভেদ, কভু প্রভু বলে ছুটি।
নজরুলের কাব্যভাবনায় প্রকাশ পেয়েছে প্রেমের বহুমাত্রিক রূপ এবং সে রূপারতি বিচিত্র অনুভাবনায় স্নিগ্ধ। যৌবনের, সুন্দরের ও প্রেমের পূজারি কবি নজরুল ইসলাম অমরতার বাণী বয়ে এনেছেন তার প্রেমের কবিতায়। সাম্য, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও স্বাধীনতা -এ সত্যসমূহ তার মানসস্বপ্ন ছিল বলেই তিনি মানবতার ধ্যানী কবি। ‘চক্রবাক’, ‘চোখের চাতক’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’-প্রভৃতি কাব্যে ফুটে উঠেছে তাঁর অমর বাসনার ঊর্মীমালা। কবি নজরুল এ ক্ষেত্রেই মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেমিক কবিশিল্পী।
লেখক: দেবাশীষ হালদার, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।