বৈশাখ ১৪৩০ মনান্তর থেকে মৈত্রী, বিজয়ের পথে পা বাড়াবার নির্দেশ

এবারের পহেলা বৈশাখ প্রভাতে যে কথাটা সবথেকে বেশি অর্থবোধক হয়ে উঠেছিলো সেটা ছিলো, শেষ পর্যন্ত তা হলে বাঘে ছাগলে এক ঘাটেই জল খেল? যদিও যিনি, যে বা যারা এই কথার উদ্যোক্তা তাদের কথায় স্পষ্ট ছিল না কোনটা বাঘ আর কোনটা ছাগল। তবে বর্ষ প্রভাতে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা আর উদীচীর বৈশাখী মেলা অর্থাৎ এই বাঘ ছাগলের যুগল উৎসবে দীর্ঘ এগারো বছর পরে, সর্বসাধারণের সাথে হাজির হয়েছিলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সকলেই। ছিলো সেই সকল খেয়ালীরাও যারা কখনো বাঘের সঙ্গে কখনো ছাগলের সঙ্গে তাদের সতঃ¯ফূর্ত স্বরশব্দাবলীর উচ্ছ্বসিত মিলনে কাটিয়ে দিয়েছেন বেলা। তাদের সবাইকে অভিবাদন। কারণ এটি ছিলো সাংস্কৃতিক নেতা কর্মীদের এ সময়ের সর্বাধিক শুদ্ধ সফল উদ্যোগ।
আমরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলাম এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন বোধবুদ্ধিহীন অসার কাজের খেসারত গুণতে হবে এগারো বছর? হ্যাঁ, তাই হয়েছে। এই শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিভাজন নিয়ে কেটে গেছে দীর্ঘ এগরো বছর। বরিশাল চারুকলা এবং উদীচীর মধ্যের এই বিভাজনের দেয়াল কাউকে বাঘ রূপ দিয়েছিল কি না আমি জানি না। তবে মানি মানতে বাধ্য হচ্ছি, আমারা উভয়েই আমাদের ছাগল রূপের বহি:প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলাম অত্যন্ত সফল ভাবে। আর আমাদের এই ব্যর্থ প্রয়াশের সুযোগে গলায় গামছা দিয়ে টেনেছে দুষ্টু বানরের দল। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তারা চরুকলার মঙ্গল শোভা যাত্রার আতুর ঘর যে, উদীচী সেই ইতিহাসকে মিথ্যা বানাতে। উদীচীর বৈশাখী মেলার বিশালত্বকে ম্লাণ করতে। এবং সর্বপরি চারুকলার মঙ্গল শোভযাত্রার একচ্ছত্রতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। তবে একই সাথে মেনে নেওয়া ভালো, এখানে ছিলো আমাদেরও কিছু ভুল সিদ্ধান্ত। যে পথ ধরেই এসেছিলো চারুকলা উদীচীর এই অনাকাঙ্খিত বিভাজন। যার সফল সমাপ্তি ঘটলো পহেলা বৈশাখ ১৪৩০ বঙ্গাব্দের মঙ্গল প্রভাতে।
ভেবেছিলাম আমাদের এই দারুন টেনশন মুক্তি এবং নিদারুন প্রশান্তির প্রয়াস যার উৎসাহ এবং উদ্যোগে হলো, সবাই মিলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। সেটা হয়নি, শেষ পর্যন্ত করা হলোই না। ছিলো সবারই ব্যস্ততা এবং সময়ের স্বল্পতা। ছিল আমাদেরই ভিতর বিশ^াস আর অবিশ^াস, জয় পরাজয়ের অর্থহীন মানসিক দ্বন্দ্ব। আর সাথে ছিলো সকলের কঠিন সাবধানতা। যাতে এমন প্রশান্তিতে ফের কেউ অশান্তির আগুন জ¦ালিয়ে দিতে না পারে। শুকরিয়া মহান ¯্রষ্টায়। দুষ্টরা এবার সেটা পেরে ওঠেনি। বরিশালের সবাই সে কথা জেনে গেছে এতদিনে। কারণ সুস্পষ্ট। আগামী সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে মেয়রের অভিপ্রায় ছিল। সকলের অংশগ্রহণে একটি অভিন্ন মঙ্গল শোভাযাত্রার। যার শুরু হবে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে। মেয়রের এমন অভিপ্রায়ে দারুন অপ্রস্তুত হলেও, প্রকাশ্যে আনন্দের জোয়ারে ভেসেছেন চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা বিভাজনের দুষ্টের দল। চোর যেমন খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন পুলিশ, তদ্রুপ মেয়রের অনবরত কেষ্ট প্রাপ্ত বিভাজনের হোতা দুষ্টুরা, ভবিষ্যতে কেষ্টযোগ হারানোর ভয়ে মেয়রের প্রস্তাব গলদকরণ করাকেই শ্রেয় মনে করতে বাধ্য হয়েছেন। দীর্ঘ এগারো বছর পর বর্তমান মেয়রের অর্থপ্রবাহের চাপে আর ঔদ্ধত্বে সুলভ্যতায় সম্ভব হলো বরিশালের মঙ্গল শোভাযাত্রার একীভূত হওয়া। যা সংস্কৃতি কর্মীদের সংস্কৃতির দায় দীর্ঘ এগারো বছরেও করতে পারেনি।
তারপরেও বলবো
‘ভালোই হয়েছে ঝঞ্ঝার বায়ে প্রলয়ের জটা পড়েছে ছড়ায়ে
ভালোই হয়েছে প্রভাত এসেছে মেঘের সিংহবাহনে।
মিলন যজ্ঞে অগ্নি জ¦ালাবে
বজ্র শিখার দহনে।’
এই যে ভালো সে চিরদিন এমন ভালোই ছিল। তবে সে ভালো রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে এসে তবেই না সর্বজনীন হলো? অন্য কারোর উচ্চারণে এমন সরল ভলোকে কেউ এত সহজে বুঝতো, আমরাও কি বুঝতাম? অতএব, সকল ঝড় ঝঞ্ঝা সংকট সংশয় অতিক্রম শেষে এক ¯িœগ্ধ প্রভাতের প্রত্যাশা- আর তার যথার্থ আগমন যদি ঘটে সেতো ভালো- ভালোই। তবে তাই হোক। ভুলে যাই সকল বিচ্ছেদ, বিবাদ। ভুলে যাই ত্যাগ করে চলে যাওয়ার নিষ্ঠুরতা। ভুলে যাই, সেই যারা ভুলে গিয়েছিল সত্য, পেম, পবিত্রতা। ভুলে যাই ঢাকের বাদ্যের বিভাজন। ভুলে যাই হাতে বাঁধা রাখী বিচ্ছিন্ন হওয়া। ভুলে যাই তাল পাখার বিচ্ছিন্ন রূপ। ভুলে যাই ঐতিহ্যের শিকড়ে দীর্ঘ এগারো বছর ধরে জল ঢেলে ঢেলে পুনরায় বৃক্ষ-পুষ্পে পত্রে পল্ববিত করে তোলা। ভুলে যাই সংক্রান্তির রাতে পথে পথে চিৎকার করে বলা ‘বরাবরের ন্যায় এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা বি.এম. স্কুল থেকেই শুরু হবে।’ ভুলে যাই মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে ঘরে বাইরে উড়ো চিঠির অম্ল-মধুর স্বাদ। ভুলে যাই তাকে অথবা যিনি বা যারা ঘরের কিংবা পরের হয়ে, প্রায় প্রতি বছর এমন একখানা লেখা লিখতেন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে নিয়ে।
হ্যাঁ, আসুন সবাই সব কিছু ভুলে যাই। শুধু মনে রাখি একটি কথা, বাঁচিয়ে রাখি একটি ধারা। যা চিরকাল বহমান থাকবে এই শহরের মানুষদের সতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে পহেলা বৈশাখ প্রভাতের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। যার শুরু বি.এম. স্কুল থেকে। যা ছিল, আছে, থাকবে চিরকাল। যদি ফের ব্যক্তি স্বার্থে খেয়ে না ফেলে সমষ্টির এই সৌন্দর্য।
আমরা যেন একটু বিবেচনায় রাখতে পারি তা হলো, আমাদের স্বার্থের চরম কিংবা পরম সিদ্ধি লাভের পরেও এই প্রকৃতিকে যেন বাঁচতে দিতে পারি, বাঁচিয়ে রাখতে পারি। প্রকৃতির স¦াভাবিক ধারা বিনাশের বিনিময়ে যে অর্জন, অপ্রকাশ্যে সে তো আমাদেরই অন্তঃক্ষরণ কিংবা মৃত্যু। অতএব তোমার আমার নখের আচরে মঙ্গলাচারের যে ক্ষরণ হয়েছে দীর্ঘ এগারো বছর, সেই দাগ মুছে যাক। মুছে যাক আমাদের সকল অন্তর্গ্লানি। কোনো জয় পরাজয় নয়। হয়তো কোনো দোষও কারো নয়। তবে এ অবশ্যই সত্য যে, আমাদের বুদ্ধিতে কিছু নির্বুদ্ধিতার বিষ জমেছিল। সেই বিষনিশ^াস বুদ্ধিহীন করে দিয়েছিল আমাদের। পরিণাম মঙ্গল শোভাযাত্রার দ্বিখন্ডিত পথ চলা দীর্ঘ এগারো বছর। কাকে দায়ী করব, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের? না, তাদের কোনই সম্পৃক্ততা ছিল না এ কাজে। এ বুদ্ধিহীন সর্বনাশ আমরাই ঘটিয়েছিলাম। বুদ্ধিহীনতার চরম উল্লাসে।
তবে ভুল করেনি এই শহরের বাঙালি অন্তঃপ্রাণ মানুষ। প্রগতি চিন্তা চেতনার অসাম্প্রদায়িক মানুষ। সেই দৃপ্তচেতা মানুষদের নিরন্তর এগারো বছরের সঠিক পথের দিশাই আবার সাবেক রূপের উন্মেষ ঘটিয়েছে আমাদের মাঝে। আমাদের বাধ্য করেছে এক মোহনায় দাঁড়াতে। শুধু বুদ্ধির সূতটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন বিসিসির বর্তমান মেয়র। শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও আমাদের বিজয় নিশ্চিত করতে বিনা বাক্য ব্যয়ে যে সুতায় বাঁধা পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা। যদিও সে অভিলাষ আজ সুদূরপরাহত। তার পরেও এক কঠিন শুদ্ধ বাস্তবতা ব্যক্তির চক্ষু লজ্জাকে অতিক্রম করে আগামী বিজয়ের পথ নিশ্চিতকল্পে পা বাড়াবার নির্দেশ দিচ্ছে।
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।