ভেজালমুক্তি

ভেজালমুক্তি
অনেক সময়ই নিশ্চিত করে বলা সহজ হয়ে ওঠে না, যে কাজটা আমরা ঠিক সময় করতে পারবো। প্রয়োজন থাকে, তাগিদ থাকে, নির্দেশ নির্দেশনাও থাকে। তার পরেও হতে চায় না। এ বিষয়টি ব্যক্তি, রাষ্ট্র এবং পৃথিবী জুড়েই আছে। এই তো বোধ করি আজই কিংবা গতকাল পত্রিকার পাতায় একটি খবর একেবারেই চোখ স্থির করে দিলো। যেখানে স্পষ্ট লেখা আনেক দিন, বছর, যুগ পরে হলেও বৃটিশ পার্লামেন্ট ভারতের জালিওয়ানাবাগ হত্যা কা-ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। না ক্ষমা নয়। শুধুই দুঃখ প্রকাশ। তারা বলতে চেয়েছে তাদের সেই কাজটি যথাযথ ছিলো না। তাও ভালো অন্তত এইটুকু তারা বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে এক সময় যাদের রাজত্বে সূর্য অস্ত যেতো না সেই গ্রেট বৃটেন। স্বাধীকার প্রত্যয়ী মানুষদের বুকে গুলি চালিয়ে রক্ত প্রবাহ তৈরি করেছিলো বৃটিশরা। যার অভিব্যক্তিতে রবীন্দ্রনাথ লিখতে বাধ্য হয়েছিলো ‘আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে’। আজ এতদিন পরে সেই বৃটিশ শাসকদের দুঃখ প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ কী একই কথা বলে চলেছেননা তার ১৫৮ তম জন্ম দিনেও? ‘যাহারা তোমার বিষাইছে তব বায়ু নিভাইছে তব আলো তুমি কী তাদের ক্ষমা করিয়াছো তুমি কী বেসেছো ভালো’? না ঠাকুর না। প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। ক্ষমা চেও না তুমি হত্যার, বিভাজনের। এই বাংলাদেশ জানে সে কথা। ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা, লাখো মা বোন স্ত্রীর সম্ভ্রম হানিকারকদের কে করে ক্ষমা, কার আছে সেই এখতিয়ার? পৃথিবীর চলমান মানুষই একদিন বুঝতে পারে তার কর্মের ভুল। সেদিন সে লজ্জিত হয়। দুঃখ প্রকাশ করে। তার পরে কোন বৃহৎ স্বার্থের প্রয়োজনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখবো পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে ৭১ এর গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে। সেদিন সেই ক্ষমার প্রয়োজনীয় রূপ মানবিক না হয়ে হয়তো হবে রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক। আমরাতো জানি, যে কোন অসংযত কর্মের প্রতিকার তাৎক্ষণিক হতে চায় না। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে এবং ঘটে। এইতো নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে আসা মুসুল্লিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারায় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ডিম ছুড়ে মেরেছে সেই দেশেরই এক নারী। তার বক্তব্য স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী কেন কোন হত্যার বিষয়ে এমন বক্তব্য দেন। কেন প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রিলিয়ার অভিবাসন প্রত্যাশিদের হাইতি ও পাপুয়া নিউগিনিতে বন্দি দশায় রাখার নির্দেশ দেন? তাই সে নারী প্রতিবাদ স্বরূপ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ডিম ছুড়ে মেরেছেন। এ কাজ কতটা যুক্তিযুক্ত ছিলো সে উত্তর দেবে সময়। এবং সে দেশের আইন আদালত। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা না হচ্ছে সেই পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের জানা থাকবে। একজন মানুষও যদি বোধ ও বিবেকের কারণে ক্ষুব্ধ হন তবে সে কতদূর পর্যন্ত আঘাত করতে পারেন। এমনটাতো হতেই পারে পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন প্রান্তে, যে কোন বিষয়ে। এই তো সেদিন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব-এর মহাপরিচালক তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। খাদ্যে ভেজালবিরোধী কোন এক অনুষ্ঠানে। তিনি সরাসরি উচ্চারণ করলেন খাদ্যে ভেজাল মুক্তিতে প্রয়োজন শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আজ একজনের উপলব্ধি এভাবে উচ্চারিত হলো। কাল থেকে যদি জনে জনে মনে করতে শুরু করেন- এটাই সঠিক। তবে? হয়তো হয়েও যেতে পারে ভেজালমুক্ত খাদ্যে পরিপূর্ণ স্বদেশ আমার। তবে কি এই রাষ্ট্রের অসামঞ্জস্যপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতার প্রয়োজনে মৃত্যুদন্ডই শেষ কথা হবে? এই দেশে ভেজাল কি শুধুমা খাদ্যে? সে যাই হোক, এই ভেজাল নিয়ন্ত্রণের আর কি কোন পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না কোন মস্তিষ্কের ভাবনায়? যদি পাওয়া না যায় তবে যে জনশুন্য হয়ে যাবে দেশ। রাজনীতির মাঠ খাঁ খাঁ করবে। শিক্ষা, প্রশাসন, রাজস্ব এবং আইন প্রয়োগের সকল ক্ষেত্রে শুধু ইমারতের জঞ্জালগুলোই পড়ে থাকবে। সকল ধর্মীয় উপাসনালয় জনমানব শুন্য হতে থাকবে। ধর্ম গুরুরা নীতি নৈতিকতার শিক্ষা বিস্তারে কোন মানুষই আর খুঁজে পাবেন না। সততার ব্যাখ্যা দিতে বেগ পেতে হবে না তেমন। কখনো কখনো হয়ে যেতে পারে এমন যে জনতাই নীতি শিখাবে তাদের। হতে কি পারে এমন রাষ্ট্র? যদি হয় তবে কেমন হবে? মানুষ কি ভালো থাকবে, যেমনটা বলি সেই আগের মত? না কি কষ্ট বেড়ে যাবে তাদের? সকল সন্তুষ্টিই কি হারিয়ে যাবে মন থেকে উন্নত বিশে^র মত! শুধুই যন্ত্রের মত বেঁচে থাকা হবে ঝকঝকে তকতকে। তবে সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা এসবের অর্থ তখন কি দাঁড়াবে? সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা কি আসর জমিয়ে গাইতে পারবো ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। হয়তো পারবো, যদি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের সকল আচরণগুলির স্বাধীন স্বকীয় মাত্রা স্থাপন করতে পারি। জাতীয় রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক উৎসব এবং ধর্মীয় আচারের ভিন্নতা যদি নির্দিষ্ট করতে পারি। খুব একটা জানি না। আমাদের মতো ধর্মভীরু মানুষদের মাঝে সেটা ঠিক কেমন করে সম্ভব হবে। মস্তিষ্কের নানান কুট কৌশল সে কার্য সম্পাদনে আমাদের কতটা সাহায্য করবে? আদৌ করবে কি না? এইতো সেদিন এক সাংস্কতিক কর্মী সম্মেলনে বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের নানান রূপ নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে। কথা বলছিলেন সম্মেলনে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় অগ্রজ সাংবাদিক সংস্কৃতিজন অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল। তিনি তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলছিলেন আমাদের দেশে কিছু কিছু উৎসবের তারিখ এখন নির্ধারিত। যেমন ১৪ এপ্রিল এখন নির্ধারিত বাংলা নববর্ষের উৎসব, ১৩ এপ্রিল সংক্রান্তি। তদ্রুপ ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত বরণ উৎসব এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ^ ভালোবাসা দিবস। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ এখন প্রচলিত নির্ধারিত রীতি বাংলাদেশে। তার পরেও পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা অনুযায়ী ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ মানতে নারাজ অনেকে। এবং কখনো তা প্রকাশ্যে। এ এক বিস্ময় বাঙালি চেতনা, সার্বজনিনত্বের এবং রাষ্ট্রীয়বোধের। তারা সবাই ১৪ এপ্রিল সরকারি ছুটি ভোগ করেন, নববর্ষের উৎসব বোনাস গ্রহণ করেন, একই সাথে ভিতরে ভিতরে ওই সরকারি সিদ্ধান্তটি অস্বীকার এবং অশ্রদ্ধা করেন। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো। সেদিন আয়োজক সংগঠনের সম্পাদক একজন সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়া সত্যেও, তিনি কি করে প্রকাশ্যে মাইক্রোফোনে এমন রাষ্ট্রীয় সিন্ধান্তের বিরোধীতা করলেন? যে মঞ্চে বসা ওই সংগঠনের সভাপতি, সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, সাংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক শাহান আরা বেগম এবং বাংলাদেশের বরেন্য সংস্কৃতি, চলচিত্র ও নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিষয়টি কি করে এদের নজর এড়ালো। কেন তারা ক্ষুব্ধ হলেন না? এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি অনেকের কাছেই। যদিও বক্তা মানবেন্দ্র বটব্যাল বলতে চেষ্টা করেছিলেন। বিষয়টি যদিও আমাদের প্রচ্ছন্ন ধর্মীয় মত তথাপিও বলতেই হয় বিষয়টি একেবারেই একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধীতা। বিষটির সুরাহাকল্পে তিনি পঞ্জিকার তারিখ সংশোধনেরও প্রস্তাব করেন। প্রশ্ন হলো যে বিষয়টি রাষ্ট্র অনুমোদন দিয়েছে তার যৌক্তিকতা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা হতেই তো পারে। কিন্তু বিরোধীতা, সে কি করা সম্ভব? আমাদের কি তা উচিত কি? অথচ আলোচনা শেষে তেমনটাই করলেন আয়োজক সংগঠনের সম্পাদক। যা ছিলো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। বিষয়টি উপস্থিত অনেক সাংস্কৃতিক কর্মীকে আহত, হতাশ এবং ক্ষুব্ধ করেছে। এই সম্মেলন স্থলে যে প্রশ্নের প্রয়োজনে এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিলো। সেই প্রশ্ন এবং উত্তর নিয়ে আরো আলোচনা হতেই পারত। সেটাই ছিলো যথার্থ। শুধু বিরোধীতা যৌক্তিক নয়। জ্ঞানের প্রসার এবং প্রয়োগের গভীরতার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের কোন সিদ্ধান্ত সে যদি কারো ভালো না লাগে, সে কথা বলার ধরণ আলাদা এবং সহনশীল হওয়া অত্যান্ত জরুরী। একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর জন্য তো বটেই। এইটুকু অবশ্যই আমাদের মনে রাখা দরকার। সার্বজনীন অর্থ শুধুমাত্র আমার নয়। তা না হলে বাঙালি চিন্তা চেতনা উন্মেষের ধারণা বাধাগ্রস্ত হবে বলেই মনে করা যেতে পারে। এই যে চিন্তার ভেজাল এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি? এই যে সাংস্কৃতিক ধারণা এবং উৎসবকে ধর্মের আচারে রূপান্তরিত করা, এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? এরকম অজ¯্র কিছুর উত্তর জানি না বলেই আমাদের কর্মের ভেজাল সুদুরপ্রশারী রূপ লাভ করে। তাই তো র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক নিশ্চই আপনি দারুন একজন ভেজালমুক্ত সৎ মানুষ, নিজ পেষায়। নিশ্চয়ই আপনার আর্থিক অর্জনে কোন অনৈতিকতার সংমিশ্রণ নেই। নিশ্চয়ই আপনার আর্জিত সকল সম্পদ প্রশ্নাতীতভাবে সাদা। তাই আপনি কোমর শক্ত করে এমন উপস্থাপনার দায় নিয়েছেন। তাই আপনি দ্যর্থহীন ভাষায় বলতে পেরেছেন ‘খাদ্যে ভেজালমুক্তিতে প্রয়োজন শাস্তি মৃত্যুদন্ড’। বর্তমান দেশে বিরাজমান ভেজাল উৎসবের সকল স্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত মানুষ, প্রতিষ্ঠান, প্রয়োজন এবং ব্যবস্থাপনার সথে সম্পৃক্ত যারা এবং সবিশেষ আমাদের পাকযন্ত্র যে এই ভেজাল বিষ ধারণ করে করে ধীরে ধীরে নিঃশে^স হয়ে যাচ্ছে তাদের সবার জন্যই কি আপানি ওই একই শস্তির দাবি করেন?