মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হই

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হই


আজ ৩ মে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকা শক্তি’।

সারা দুনিয়ায় মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে তথ্য তত্বগত বিশ্লেষণ হবে। কিন্তু গণমাধ্যম যে দিন দিন নিয়ন্ত্রণের শিকলে বাধা পড়ছে সে বিষয়টি জোরেসোরে উঠে আসছে না। কর্পোরেট চিন্তার ফসল এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা লাভ করায় প্রতিদিনই নিয়ন্ত্রণ রেখার আবর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে এই পেশার নাগরিকরা। প্রভাব মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার ফসল নানান কালো আইন দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম একটি হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

এই আইনের নেতিবাচক প্রভাবেও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্যবসায়ীক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় এই ধারা থেকে মুক্তি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান না হলে গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাদারিত্ব, জীবন-জীবিকা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। থাকবে না কাজের নিশ্চয়তাও। বিশ^ গণমাধ্যম দিবসে এই বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা দরকার।


সারা দুনিয়ায় গণমাধ্যম প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বলা যায়, সারা দুনিয়া গণমাধ্যমের আওতায় এসেছে। তবে নাম মাত্র সংবাদ প্রকাশই গণমাধ্যমের একমাত্র কাজ নয়। সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্র বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবমুক্ত হলেই গণমাধ্যমের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব হবে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণমাধ্যম তৈরি করা গেলে বৈশ্যিক কেবল মুক্ত গণমাধ্যম নয়, মুক্তভাবে লেখনি এবং কাজের নিশ্চয়তা একান্ত দরকার। সেজন্য প্রয়োজন প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম।বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ও ভয়ভীতি আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে সারা দুনিয়ায় গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। করোনার কারণে সেই ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়েছে।অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাটাই শুরু হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যা মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।গোটা বিশে^ মুদ্রিত খবরের কাগজের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন, বেতার গণমাধ্যমকে আভিজাত্য এনে দিয়েছে। এ ছাড়া মুঠোফোন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটে ইউটিউব, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম্যমকে নতুন যুগের গণমাধ্যম হিসেবে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। এতকিছুরপরও গণমাধ্যমে অনিশ্চয়তার অক্টোপাস জাপটে ধরে আছে। স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা নেই।

পেশাদারিত্বের বিকাশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। কর্মহীন হওয়া এবং জীবন-জীবীকা নিয়ে দিন দিন গণমাধ্যম কঠিন সংকটে আবর্তিত হচ্ছে।আমরা জানি, সংবিধানের বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমের স্বাাধীনতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণমুক্ত গাণমাধ্য প্রতিষ্ঠা। কিন্তু নিয়ন্ত্রণমুক্ত তো হতে পারেইনি, উল্টো বেশি বেশি নিয়ন্ত্রণ রেখা দ্বারা আটকে দেওয়া হচ্ছে। তারপরও সংবিধানের ওপর আস্থা রেখেই চলছে গণমাধ্যম।৩ মে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ অথবা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যম বিষয়ক সচেতনতা।বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইন কমিশন ও বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যগতভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতেই ভূমিকা পালন করে থাকে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য ছিল ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার কালাকানুন বাতিল করা। এ জন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।বাকস্বাধীনতা কিংবা অধিকারের রক্ষাকবচ অবশ্যই যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষেই নাগরিক ও সাংবাদিকেরা ভোগ করে থাকেন। কেউ সেই বিধিনিষেধ না মানলে তাঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। গণমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রেস কাউন্সিলকে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তাও আমরা অস্বীকার করছি না। তাই বলে সেটা কেবল তার পুলিশি শক্তি বাড়ানোর ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে যে কালাকানুন বাতিল হয়েছে, সেটি ফিরে আসলে যেমন গণমাধ্যমের ওপর আঘাত, তেমনি গণতন্ত্র ও সভ্যতারও পরিপন্থী। মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা সব ধরণের কালাকানুন, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাধা ও হুমকির অবসান।সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ পালিত হয়।আমরা যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষপটের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকীতে পরে এমন তথ্য ব্যতিত অন্যান্য সকল বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে। আর এই তথ্য সেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন সংবাদকর্মীরা। তাই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি বিশ^ব্যাপী সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টির দিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। তবে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটও প্রকট করে তুলেছে। সর্বশেষ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম  এটা দেশের গণমাধ্যমের নাজুক পরিস্থিতিই প্রমাণ করে। বিশেষ করে, গত এক দশকে এই দুই সূচকেই বাংলাদেশের নিম্নক্রমে স্থির অবস্থান কিংবা ক্রমাবনতি পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে নির্দেশ করে।

মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন আর্টিকেল-১৯ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে আসছে। সংগঠনটি ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ৫৮৪টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে। তাতে দেখা যায়, এর মধ্যে ১১৫টি মামলায় ২২৯ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়েছে ১৩টি মামলা।আমরা বলতে চাই, নির্ভিক সংবাদকর্মী পেতে চাইলে সবার আগে তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তা দিতে হবে। তা না হলে দিন শেষে কোন এক অদৃশ্য পিছুটান তাকে বাধ্য করবে অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করতে। সংবাদ মাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করাও একান্ত প্রয়োজন। একপাক্ষিক মতাদর্শের প্রচার কখনোই সংবাদ মাধ্যমের কাম্য নয়। কাজেই গণমাধ্যম কর্মীদের নিরপেক্ষ থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতে হবে। গণমাধ্যমকে সবসময় মুক্তভাবে কাজ করতে হবে।

মুক্তভাবে কাজ করা গণমাধ্যমের একটি মৌলিক বিষয়।এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার দেশের সুন্দর ও সুস্থ্য আইন, আইনকানুনের যথাযথ প্রয়োগ, ক্ষমতাশীলদের উদার মানসিকতা। পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মাঝে সত্য সহ্য করার ক্ষমতা গড়ে উঠতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতি ও ব্যবসা নির্ভর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। অনেক সময় বন্তুনিষ্ঠ সংবাদগুলো কোনো একটি মহলের বিরুদ্ধে গেলেই তারা বাধসাধে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও হতে হবে আরো দায়িত্বশীল। তাদের বুঝতে হবে ঘোষিতভাবে না হলেও অঘোষিতভাবে তাদের দায়িত্ব অনেক বড়। শুধু মুক্ত গণমাধ্যম নয়, মুক্ত ও সুস্থ্য গণমাধ্যম তৈরি করতে হবে।