‘মায়ের মতো আপন কেহ নাই রে কিংবা মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মতো ঝড়ে, মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে’। মাকে তো মনে পড়তেই হবে। মাকে মনে না পড়লে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্বই থাকবে না। যার রক্তে-মাংসে গড়ে ওঠা আমার কিংবা আমাদের এই দেহঘড়ি। সেই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার দিন আজ। বিশ্ব ‘মা’ দিবস বলেই মাকে মনে পড়তে হবে তা কিন্তু নয়। মাকে মনে রাখতে হবে দিন দিন প্রতি দিন। তারপরও একটি দিন বিশেষভাবে মায়ের জন্য, বিশ^ মা দিবস।
মা। ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ এর ব্যাপ্তি দিগন্ত জোড়া। মা কেমন হয় তার প্রমাণ দেওয়া কঠিন। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মায়ের পরিচয়, সন্তানের জন্য স্নেহ-ভালোবাসার অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। তারপরও কোন কোন মায়ের আত্মদান আমাদের সামনে মায়ের পরিচয়কে আরো হৃদয়গ্রাহী ও মর্মষ্পর্শী করে তুলে। মা যে কত রকম ত্যাগ করতে পারেন তা কেবল ওইসব মায়েরাই জানেন। আমরা তার অতি ক্ষুদ্র অংশ জানি এবং দেখি।
আমরা জানি, প্রতিবন্ধী সন্তানকে কোলে করে খাওয়ানো, গোসল করা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজেও কোলে বহন করে চলেছেন মা। এমন একজন মায়ের নাম সীমা সরকার। এই মা তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তান হৃদয়কে কোলে কলে করে নিয়ে গেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। প্রতিদিন তিনি এখনো সন্তানকে কোলে করেই নিয়ে যাচ্ছেন বিশ^বিদ্যালয়ে।
হৃদয়ের মায়ের ঘটনা আমাদের মায়ের প্রতি আরো শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। এটা তো বর্তমান ঘটনা। এমন না জানা অনেক ঘটনা আছে যা শুনলে কিংবা জানলে শরীরে ভয়ের শিহরণ, ঠোঁট ভারি এবং চোখ ভিজে উঠবে। মায়েরা সন্তানের জন্য এমনও ত্যাগ করতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তারপরও দেখি কোন কোন সন্তান মায়ের খোঁজ রাখেন না। গোয়ালঘর, ঝুপড়ি ঘরে রেখে দেওয়া হয় মাকে। তারপরও মা সন্তানের শুভ কামনা করে চলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তারপরও মা কামনা করেন ‘আমার সন্তান থাকুক দুধে আর ভাতে।’ কোন দিন সন্তানের বিরুদ্ধে মা কোন অভিযোগ দাখিল করেন না। কিন্তু আমরা সন্তান হিসেবে কি করে বেড়াই।
১৯৭১ সালের এক মায়েক কথা না বললে বিশ^ মা দিবস পালন মূল্যহীন হয়ে যাবে। এই মায়ের নাম সাফিয়া বেগম। ৭১-এর গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিল সন্তান আজাদ। পোশাকী নাম মাগফার আহম্মেদ চৌধুরী আজাদ। পাক বাহিনী ১৯৭১ সালে নির্মম নির্যাতন করে আজাদকে। একদিন থানা হাজতে সন্তানকে দেখার সুযোগ পান মা সাফিয়া বেগম । সেদিন সেই মা পাক বাহিনীর কাছে কোন তথ্য না দেওয়ার জন্য সন্তানকে সাহস দিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘যত নির্যাতনই করুক, অন্য কোন সন্তানের সন্ধান পাক বাহিনীকে দিবা না’। আজাদ মায়ের কথা রেখেছে।
আজাদ খুব ভাত খাওয়া পছন্দ করত। থানা হাজতে সেদিন আজাদ মায়ের কাছে ‘ভাত’ খাওয়ার আবদার করেছিল। মা সাফিয়া বেগম পরদিন ভাত নিয়ে আসবেন বলে আজাদকে আস্বস্ত করে বাসায় ফেরে। পরদিন আজাদের পছন্দমত খাবার তৈরি করে আজাদের মা সন্তানের জন্য থানায় ভাত নিয়ে হাজির হন। কিন্তু আজাদের সঙ্গে মায়ের আর দেখা মেলে না। থানায় গিয়ে আজাদের কোন সন্ধানও তিনি পাননা। এর এক থানা থেকে অন্য থানায় সন্তানের খোঁজ করে চলেন আজাদের মা। কিন্তু আজাদের সঙ্গে দেখা তো দূরের কথা সন্ধানও পাননি। ধারণা করা হয় আজাদকে তথ্য না দেওয়ার জন্য পাক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।
আজাদের মা সাফিয়া বেগম সেদিন থানায় ভাতের ক্যারিয়ার ফেলে আহাজারী করেন। গগবিদারী আহাজারীতে পরাধীন বাংলাদেশের প্রকৃতি কেঁদে উঠলেও মন গলেনি পাকবাহিনীর। সন্তানহারা মা বাড়ি ফেরেন। কিন্তু থানা হাজতে রেখে আসেন ভাতের বাটিসহ জীবনের অনেক কিছু। এরপর থেকে তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন ভাত মুখে তোলেননি। তিনি ভাবতেন তাঁর সন্তান আজাদ এসে একদিন ভাত চাইবে। সেদিন তিনি সন্তানের সঙ্গে ভাত খাবেন। কিন্তু আজাদ আর ফিরে আসেনি। মা সাফিয়া বেগমেরও আর ভাত খাওয়া হয়ে ওঠেনি।
সেদিন থানা হাজতে ছেলেকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে এসেছিলেন সাফিয়া বেগম। তাই সাফিয়া বেগম ভাত খাওয়া বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শোয়াও বন্ধ করে দেন। শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা সব ঋতুর সব রাতে মেজেতে শুয়ে কাটিয়েছেন। আজাদ মারা যাওয়ার পর এই মা ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন। পুরো চৌদ্দ বছরই সন্তানের শুভকামনা করে মেঝেতে শুয়ে কাটিয়েছেন। কেবল একটুকরো কাপড় ছিল শীত নিবারণের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের আগে সাফিয়া বেগম বিলাসবহুল জীবন যাপন করেছেন। ঢাকার ইস্কাটনে কয়েক একর সম্পত্তির বাড়িতে ছিল আধুনিক সব ব্যবস্থা। স্বামী সঙ্গে মতদ্বৈতার কারণে সেই বিলাস ছেড়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন তিনি। তাকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তার স্বামী। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাফিয়া বেগম সন্তান নিয়ে ছিলেন অন্য বাড়িতে। স্বামীর কথায় সম্মত না হওয়ায় তাঁর নামের দ্বিতীয় বাড়িও ছাড়তে হয় সাফিয়া বেগমকে। নিজের জমানো অর্থে একমাত্র সন্তান আজদকে পাকিস্তানের করাচিতে পড়িয়েছেন। পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়সহ দীর্ঘ সময় সাফিয়া বেগম সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে ছিলেন। সন্তান হারিয়ে বাড়ি বদল করে করে শেষ পর্যন্ত বস্তিতে কেটেছে শেষ জীবন। দেশের লাখো লাখো মায়ের সন্তান রক্ষায় সাফিয়া বেগম একমাত্র সন্তানকে দেশের জন্য, মুক্তির জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই মায়েদের সন্তানরা রক্ষা পেয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এই দেশের কোটি কোটি মায়ের সন্তানরা সেদিনের মাকে ভুলে আছে। মনে রাখছে না সেই মাকে। আমদের সবার মায়ের সঙ্গে সেই মাকেও স্মরণ করতে হবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে হবে।
বিশ্ব মা দিবসে আমার মায়ের সঙ্গে সেদিনের মা সাফিয়া বেগম, গেরিলা বাহিনী সদস্য শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমাম, আজকের মা সীমা সরকারসহ সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বিশ^ মা দিবস যেন মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ পাই গর্ভে থাকা শিশুর মতো। যে মা তাঁর নাড়ীর সঙ্গে আমাকে বেঁধে রেখে ১০ মাস পর পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেই মা যেন আমি কিংবা আমাদের দ্বারা কোনভাবে কষ্ট না পায়। বৃদ্ধাশ্রম যেন মায়ের ঠিকানা না হয়। বিশ্ব মা দিবসে এই কামনা করছি।