মাসিমা ছিলেন মানব ধর্মের জয়গানের সুরস্রষ্টা

মাসিমা ছিলেন মানব ধর্মের জয়গানের সুরস্রষ্টা

কে তাঁর নাম রেখেছিল জানি না। তবে যিঁনিই রাখুন তিনি যথার্থ নাম-ই রেখেছিলেন। ‘মনোরমা’। এই মনোরমার পরশে মনোরম হয়ে উঠেছিল বরিশাল তথা দেশ। পিছিয়ে পড়া নারীদের ভরসা, দেশাত্মবোধ, সাম্প্রদায়িকতাকে পদদলিত করে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ধারক এই মনোরমা। কঠিন ও ঘোর অমানিশায় আলোর দিশারীও এই মনোরমা। আলোর মশাল জে¦লে অন্ধকার দূর করে প্রগতির পথকে সহজ করে দিয়েছেন তিনি। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের নাম মনোরমা। সমাজ সংস্কারক, ব্রিটিশ তাড়ানো নিবেদিতপ্রাণ মনোরমার নামের পেছনে যুক্ত হয় কমরেড মনোরমা। পরবর্তী সময় বসু পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে কমরেড মনোরমার সামনে নতুনপদবী যুক্ত হয় বসু। কমরেড মনোরমা বসু হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকেন তিনি।

মনোরমা নামের ছোট্ট শিশু সবার ‘মাসিমা’ ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামে রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা প্রমোদ সুন্দরী ও পিতা নীলকণ্ঠ রায়। জন্মস্থানের অনুকূল পরিবেশ মনোরমাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালের বাঁকাই গ্রামের জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। প্রগতিবাদী স্বামীর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এই কমরেড মনোরামা বসু অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়। না মুছে যায় না। ওই নামের অলংকার বৃদ্ধি পায়। সেটা তার কাছে অলংকার হিসেবে ছিল কি না জানা নেই। স্বামী, পরিবার, পার্টির পদবী কতটা তিনি উপভোগ করতেন সেটাও জানা নেই। তবে তিনি যে মাসিমা ডাকটি উপভোগ করতেন, সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। কারণ ছোট, বড়, ধনী-গরীব, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই তাঁকে মাসিমা বলেই ডাকতেন। তইতো কমরেড মনোরমা বসু মাসিমা হয়ে ওঠেন সকলের ‘মাসিমা’। সব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর পরিচয় হয় মনোরমা বসু মাসিমা। তবে মনোরমা আর বসু অনেকটা পোশাকী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিনি আজো সবার কাছে ‘মাসিমা’ হয়েই আছেন। থাকবেনও মাসিমা হয়ে। এই কালজয়ী মহিয়সী নারী আমাদের সবার মাসিমা’র আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

মনোরমা বসু মাসিমা ছিলেন সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন সাচ্চা মানুষ। বলতে গেলে সোনার দেশের খাঁটি সোনার মানুষ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন ও সাম্যবাদী চিন্তার অনন্য কারিগর মনোরমা বসু মাসিমা। নারীমুক্তির আন্দোলনকে তিনি নিজের অন্তর দিয়ে লালন করতেন। পিছিয়ে পড়া নারীকে প্রগতির পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন মাসিমা। তাঁর নেতৃত্বেই বরিশালে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গড়ে উঠে। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। অনাথ ও দুঃস্থ নারীদের, বিশেষ করে বিধবা ও কুমারী মেয়েদের আশ্রয়দানের জন্য বরিশালের কাউনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’। আজীবন তিনি এই মাতৃমন্দির আশ্রমটি পরিচালনা করেছেন। তাঁর নির্মিত মাতৃমন্দির হয়ে উঠে নারী শিক্ষাকেন্দ্র ও সেবাশ্রম। মাসিমার মাতৃমন্দির আজ বরিশাল নগরীর মাতৃমন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপ পেয়েছে।

স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনোরমা বসু মাসিমা গ্রামে গ্রামে নারীদের চরকাকাটা শিখিয়েছেন। ১৯২১-২২ সালে ‘চরকা ধরো/ খদ্দর পরো’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাসিমা ওই কাজে নিজেকে নিবেদন করেন। ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে মাসিমাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। ব্রিটিশ আইন অমান্য ও রাজনৈতিক নানা কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন মাসিমা। তবে জেল-জুলুম দিয়ে মাসিমাকে আর আন্দোলন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। প্রগতির পথে চলা মহিয়সী নারী মাসিমা চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। আদর্শের প্রশ্নে মাথা নত করেননি তিনি। আজীবন আদর্শ ধারণ ও লালন করেই কাজ করে গেছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

মনোরমা রায় চিন্তহরণ বসুর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে পরে মনোরমা বসু হিসেবে পরিচিতি পান। তবে সেই পরিচয় তাঁকে বেশিদিন বহন করতে হয়নি। কারণ দৃঢ়চেতা নারী মনোরমা বসুকে জমিদারীর নিয়ম শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা সম্বব হয়নি। জমিদার বাড়ির রক্ষণশীলতা ও বিধিনিষেধ অতিক্রম করে তিনি মুক্ত জীবনে প্রবেশ করেন। এক পর্যায়ে তিনি জমিদার বাড়ি ছেড়ে বরিশালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বে স্বদেশি আন্দোলনে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যণীয়। কেবল বরিশাল শহরেই নয়, সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়েই ব্যাপক সংখ্যক নারীদের তিনি সংগঠিত করে নারী অধিকার আদায়ে তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন।

১৯৪৩-৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দিলে মাসিমা লঙ্গরখানা, চিকিৎসালয় ও উদ্ধার আশ্রম স্থাপন এবং পুনর্বাসন কাজে সর্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। ওই সময় বরিশাল শহরে ১৪টা লংগরখানা খোলা হয়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তা সেইসব লংগরখানার মাধ্যমে বিলিয়ে দিতেন। মেডিকেল টিম পরিচালনা করে বাঁচিয়ে তুলেন হাজারো দুস্থ মানুষকে। বরিশাল জেলার বিভিন্ন নারী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, সমাজসেবামূলক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মাসিমা।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এসময় মাসিমা উদ্বিগ্ন হয়ে পরেন। ১৯৪৮ সালে বরিশালের খাদ্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তিনি এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। সেইসঙ্গে জননিরাপত্তা আইনে আরও তিন বছর কারাভোগ করেন। শেষ দুই বছর মনোরমা বসু মাসিমাকে রাজশাহী জেলে কাটাতে হয়েছে। রাজশাহীর জেলে তাঁর সঙ্গে বন্দি ছিলেন কমরেড নলিনী দাস, ইলা মিত্র, ভানু চ্যাটার্জি, অপর্ণা, অমিত, সুজাতা। জেলে বসেও তিনি সংগঠন গড়েছেন আর একের পর এক কবিতা লিখেছেন। কয়েদিদের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন। জেলে বসে চলতো পার্টি শিক্ষা, নারী অধিকারের শিক্ষা, অধিকার আদায়ের শিক্ষা; চলতো নানা রকম হাতের কাজের শিক্ষা।

১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালের ১০ মে তাঁর স্বামী চিন্তাহরণ বসুর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যেই গভর্ণরের শাসনের কারণে তদানীন্তন পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। প্রদেশব্যাপী আবার শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। অন্য অনেকের সঙ্গে মনোরমা বসুর নামেও জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তিনি তখন আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন এবং সেই অবস্থার মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য গণসংগঠনের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৫৬ সালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হলে বরিশালে ফিরে আসেন মাসিমা। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় আত্মগোপন থেকে ফিরে ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’-এর কাজে ব্যস্ত থাকেন মাসিমা। পরবর্তী সময় তিনি গড়ে তোলেন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লি কল্যাণ অমৃত পাঠাগার ও শিশুদের জন্য মুকুল মিলন খেলাঘর।

১৯৬২ ও ৬৪’র স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন এবং ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও মাসিমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে এর প্রতিরোধেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেন মাসিমা। ১৯৭০-এর বন্যা পরবর্তী সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে, বন্যায় বিপর্যস্ত বিভিন্ন জেলার দুর্গত মানুষের কাছে তা বিলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে আবার পার্টি সংগঠনের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। নলিনী দাস, মুকুল সেনসহ বেশ কয়েকজন পার্টি-নেতার দেখাশোনার ভার গ্রহণ করেন তিনি। কমরেড মনোরমা বসু মাসিমা ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল জেলা শাখা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীমুক্তি আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে তোলেন। আমৃত্যু তিনি মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় মাসিমা অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। এরই মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি আন্দামান যান। সোভিয়েত নারী কমিটির আহ্বানে সোভিয়েত ইউনিয়নেও যান তিনি।

মাসিমা উপলব্ধি করেন প্রগতির পথকে সুগম করতে হলে সাংস্কৃতিক গণসংগঠন গড়ে তোলা দরকার। শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেন এর হাতে গড়া সংগঠন উদীচীর কর্মকাণ্ডকে মানুষে রমাঝে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন মাসিমা। এরই ধারাবাহকতায় ১৯৭৪ সালের মধ্য আগস্টে তিনি বরিশালে উদীচীর শাখা গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর নির্মিত মাতৃমন্দিরে বসেই বরিশাল উদীচীর যাত্রা শুরু হয়। ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আবারো আত্মগোপনে যান এবং আত্মগোপনে থেকেই খেলাঘর, উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, মহিলা পরিষদকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক শিল্পী-সংগ্রামী উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা কমরেড সত্যেন সেনের লেখা ‘মনোরমা মাসীমা’ ্র্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

নারী জাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মহিয়সী নারী কমরেড মনোরমা বসু মাসিমা। আমাদের সবার সামিসা ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর  স্বজনদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ত্যাগ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। মনোরমা বসু মাসিমা পৃথিবীতে না থাকলেও তাঁর আদর্শ আজো অম্লান আছে। কঠিন সময়ে নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ, ধর্ম নয়, মানব ধর্মের জয়গানের সুরস্রষ্টা কমরেড মনোরমা বসু, আমাদের মাসিমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।