যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ঘৃণ্য হামলার ২০তম বার্ষিকী, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কোথায়

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ঘৃণ্য হামলার ২০তম বার্ষিকী, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কোথায়

৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার ২০তম বার্ষিকী নানাভাবে স্মরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিহাসের ওই ঘৃণ্য হামলায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। প্রায় দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে হাজির হন ওসামা বিন লাদেন, হামিদ কারজাই, জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং কলিন পাওয়েলসহ আরও বেশ কয়েকজন।

ওসামা বিন লাদেন: যিনি জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর তার নাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। আফগানিস্তানের গুহায় বসে তিনি কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা চালাতে পারেন, তা নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে জনমনে। তাকে ধরতে দীর্ঘদিন অভিযান পরিচালনা করে পশ্চিমা বাহিনী। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর অভিযানে নিহত হন লাদেন।

হামিদ কারজাই: সেই সময় তালেবান গোষ্ঠী ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পশ্চিমাদের কাছে শক্ত তদবির করেন হামিদ কারজাই। এর পরেই আফগানিস্তানে পা রেখে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। পরবর্তীতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন হামিদ কারজাই। ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যান তিনি। বর্তমানে দেশটির অন্যতম রাজনীতিবিদ। আফগানিস্তানের ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে সম্প্রতি তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা হয় তার।

জর্জ ডব্লিউ বুশ: যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ তম প্রেসিডেন্ট বুশ। ফ্লোরিডার একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ‘দ্য পেট গোট’ বই পড়ানোর সময় প্রেসিডেন্ট বুশকে সন্ত্রাসী হামলার খবর দেওয়া হয়। ঘটনার দিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা দেন এই জঘন্য হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে। তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্বও দেন তিনি। টেক্সাসের তৈলচিত্রের জন্য দীর্ঘদিন অবসর নেন বুশ। সম্প্রতি আফগানিস্তানের ঘটনাগুলো নিবিড়ি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

ডিক চেনি: ৯/১১-এ হামলার সময় ডিক চেনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন। ওই দিন গোয়েন্দা সংস্থা যখন প্রেসিডেন্ট বুশের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি হোয়াইট হাউসের বাংকারে ঢুকে পড়েন। পাঁচবার হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি এখনও বেঁচে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জীবিত ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে প্রবীণ ধরা হয়।

রুডি গিলিয়ানি: এক সময় নিউইয়র্কের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন রুডি গিলিয়ানি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বিধ্বস্ত নগরীকে দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছিলেন গিলিয়ানি। জনপ্রিয় মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অপেরা উইনফ্রে তাকে ‘আমেরিকার মেয়র’ হিসেবে সম্বোধন করেন। টাইম ম্যাগাজিন গিলিয়ানিকে বর্ষসেরা ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেন তিনি।

কন্ডোলিৎজা রাইস: বুশের শাসনামলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়েদার হামলার আশঙ্কা করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন সিআইএর পরিচালক জর্জ টেনেটনের সঙ্গে আলোচনাও করেন তিনি। তিনি এখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হুভার ইনস্টিটিউশনের পরিচালক।

কলিন পাওয়েল: প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন কলিন পাওয়েল। ৯/১১ তিনি পেরুর রাজধানী লিমায় অবস্থান করছিলেন। ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘে মামলা করতে চেয়েছিলেন কলিন। এজন্য তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কপিট্যাল হিলে হামলার পর রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগ করেন কলিন পাওয়েল।

৯/১১ ধ্বংসস্তূপে গড়ে ওঠা যে ‘নতুন পৃথিবী’ স্থায়ী হয়নি বেশিদিন: 

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সকালের পর বদলে যায় বিশ্ব। যে ইরানে প্রতিদিন শোনা যেত আমেরিকার পতন হোক, সেখানে নিহত মার্কিনিদের স্মরণে মোমবাতি জ্বলে। রাশিয়ার প্রভাবিত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি সহায়তার ঘোষণা দেন ভ্লাদিমির পুতিন। ‘ভয়ঙ্কর শাসক’ মুয়াম্মার গাদ্দাফি আমেরিকার পাশে দাঁড়ানোকে ‘মানবিক কর্তব্য’ আখ্যা দেন। আমেরিকার দীর্ঘ দিনের শত্রুরা মিত্র হয়ে উঠে এক কাতারে দাঁড়ায়। তবে এই বিরল বদল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো নিজেদের সুনাম ও প্রভাব বিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ পায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় এক দশক পর বিশ্বের এক কর্তৃত্ব হাতে তুলে নেওয়ার নৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পায় যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু এসব সুবিধা শিগগিরই নষ্ট হয়ে যায়। সন্ত্রাস দমনে সামরিক ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মুসলিম দেশগুলোর অভিবাসী বিরোধী মনোভাব জোরালো হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষকে রক্ষার নামে ক্ষোভ, তিরস্কার আর স্বঘোষিত দেশপ্রেমের নামে নজরদারি জোরালো হয়ে ওঠে।

বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এর প্রভাব পড়ে। ইউরোপে ডানপন্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। চীন ক্রমেই বৈশ্বিক ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে থাকে।

পুনরায় বিশ্বাস স্থাপনে নেমেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু তা সহজ নয়। তিনি যুদ্ধ শেষ করছেন। কিন্তু এর পরে কী?

২০০১ এ হামলার পর প্রতিশোধের রক্তের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রণীত বাইনারি অবস্থানে- ‘হয় আমাদের সঙ্গে নয়তো সন্ত্রাসবাদের পক্ষে’ বিভক্ত হয়ে পড়ে পুরো সমাজ। স্কুল বোর্ড, ফেসবুক পোস্ট আন্তর্জাতিক রাজনীতি সব জায়গাতেই বিভাজন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শত্রুর ধারণা বিবর্তিত হয়ে সেই তালিকায় ঢুকে পড়ে অভিবাসীরাও। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে দেশপ্রেম। আর এসব বিভাজনকে এক সুতোয় গেঁথে প্রেসিডেন্ট হয়ে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বিশ্বজুড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তির কারণে দুর্বল হয়েছে আল কায়েদা। ২০০৫ সালের পর পশ্চিমে নতুন কোনও হামলা চালাতে পারেনি তারা।
তবে সামরিকায়ন জোরালো হয়েছে। বড় থেকে শুরু করে ছোট শহরগুলোও এখন সন্ত্রাস মোকাবিলার নামে নিজস্ব সামরিক যান ও অস্ত্র রয়েছে। সরকারি অফিসগুলো হয়ে পড়েছে দুর্গ। বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বাড় বাড়ন্ত।