রবি শংকরের সেতার হ্যারিসনের গান আমার বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আজ ৫১ বছর পূতির দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দিক নির্দেশনা। পরাধীন বাংলায় জাতীয় চার নেতার বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব, বীর বাঙালির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধ আমদের লাল-সবুজের মানচিত্র। ৩০ লাখ শহীদ ২ লাখের বেশি মাব-বোনের ক্ষত-বিক্ষত আঁচল আমাদের শান্তি পতাকা। এর সঙ্গে কৃষিক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের আত্মদানের এক উজ্জ্বল ইতিহাসের পথ চলার নাম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ অর্জনে নিবিড়ভাবে পাশে থেকে সহযোগিতা দিয়েছে ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়াসহ বেশ কিছু দেশ।
যাঁরা একটি ফুলকে বাঁচাতে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। যতোদিন বাংলাদেশ নামের এই লাল-সবুজের দেশ থাকবে ততোদিন বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে তাদের রক্তঋণ মনে রাখবে। মনে রাখবে আর্থিক, মানসিক এবং শারীরিক সহযোগিতার কথাও। যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশ না নিয়েও দেশ-বিদেশের অসংখ্য, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। তাদের সবার কথা বলা কঠিন। এঁদের মধ্যে উপমহাদেশের বরেণ্য সেতার বাদক প-িত রবিশঙ্কর এবং আমেরিকার সঙ্গীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের কথা বলতে চাই। কারণ রবিশঙ্করের সেতার এবং জর্জ হ্যারীসনের কালজয়ী সঙ্গীত আমাদের বাংলাদেশ হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার গণহত্যার ফলে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ বিপর্যরে মুখে পড়ে। এই সময়ে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের ভরণপোষণ করতে গিয়ে ত্রাণসামগ্রীর অভাব দেখা দেয়। বিষয়টি সেতার বাদক রবিশংকরকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে মুক্তিকামী বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী হওয়া হয়। সেই তাড়না থেকে বিষয়টি নিয়ে তাঁর শিষ্য ও বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আলাপ করেন। রবিশংকরের আলোচনায় সাড়া দেন জর্জ হ্যারিসন। হ্যারিসনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রবিশংকর, হ্যারিসনকে আমেরিকাতে একটি দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠান (কনসার্ট) আয়োজনের জন্য অনুরোধ করেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে রবিশংকরের যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে কনসার্টের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন হ্যারিসন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। প-িত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটল্সের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৬৫ সালে এক রাতে রবিশংকরের সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ হ্যারিসনের। হ্যারিসন বছর তিনেক সেতার নিয়ে অনুশীলন করেছিল রবিশংকরের কাছে। সেই সূত্র ধরে প্রথমে গুরু-শিষ্য, পরে তা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। ররি শংকরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সঙ্গে হ্যারিসনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০০৫ সালে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানুষের জন্য আয়োজিত কনসার্টটির কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাঁর অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে গিয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবিশংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে। অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটল্স ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এ সময় রবিশংকর জানায়, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে সে জর্জকে পাশে পেতে চায়। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবিশংকরকে নিয়ে কনসার্ট আয়োজন করেন। ওই কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু।’
জর্জ হ্যারিসন যখন দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন বিটল্সের সহশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্বস্তিকর ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি আত্মাভিমান ত্যাগ করে সহশিল্পী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনসার্টে অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানান। বিটল্সের ড্রামার রিঙ্গো স্টার রাজি হয়েছিলেন এক কথায়। বিল প্রেস্টন, লিওন রাসেলও প্রথমবারেই রাজি হলেন। বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনও প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দিলেন। কিছুটা অনিশ্চয়তার পর দুজনই অংশ নিয়েছিলেন।
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। অসাধারণ গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন এত বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল কনসার্টটি যে পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
মজার ব্যাপার হলো ওই কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে ২ লাখ, ৪৩ হাজার, ৪১৮ দশমিক ৫১ মার্কিন ডলার সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ শরনার্থী শিবির এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযাগিতায় দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ১৯৭১ সালের বিভিষিকাময় অধ্যায়ে বাংলাদেশের জন্য ওই পরিমাণ অর্থ সহায়তা সত্যিই আজো অনন্য উদাহারণ হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অর্থ সহায়ত আরও কোন কোন স্থান থেকে হয়তো এসেছিল। কিন্তু কোন দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে এতো পরিমান অর্থের যোগান অবিশ^াস্য। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর পর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হলো দুনিয়াভর। কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ৫১ বছর আগের দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক আমরা। বিজয়ের এই পূণ্যলগ্নে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি বীর শহীদসহ যারা সেদিন আত্মত্যাগ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্বে আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা দিয়েছে তাদেরও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। যে বাংলাদেশ অর্জনের জন্য ৯ মাসের শসস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে। যার মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ আমাদের এই জাতীয় সঙ্গীত যতোদিন থাকবে, বাঙালি জাতি যতোদিন বিজয় এবং স্বাধীনতা দিবস পালন করবে ততো দিন রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসনও আমাদের মাঝে থাকবে। তাই আবারও বলতে চাই, রবিশংকরের সেতার এবং জর্জ হ্যারিসনের গান, আমার সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ।