রাফি ‘টিকটক’র প্রলোভনে আট বছরে ৫ শতাধিক নারী পাচার

সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে দুই দেশেই বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের তথ্য বেরিয়ে আসে। এই চক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফিসহ চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
র্যাব দাবি করছে, আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি (৩০) গত আট বছরে ৫০০ নারীকে ভারতে পাচার করেছেন। ওই ৫০০ নারীকে পতিতাবৃত্তির কাজে পাচার করা হয়
মঙ্গলবার (১ জুন) সন্ধ্যায় র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
চক্রের গ্রেপ্তার বাকি চার সদস্য হলেন- রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদা বেগম ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)।
র্যাব জানায়, এই চক্রে ৫০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। যারা বিভিন্নভাবে কাজ করে বস রাফি নারীদের ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। রাফির চক্রে যারা দালাল ছিল তারা এসব মেয়েকে বলতো সেখানে (ভারতে) তারা স্মার্টলাইফ লিড করছে। ভিডিও কলে বিভিন্ন বিলাসী জীবন-যাপনের কথাও বলতো।
টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট দেশে কাজ করত। এছাড়া রাফির সঙ্গে নারী সহযোগী হিসেবে ম্যাডাম সাহিদা ও তার দুই মেয়ে কাজ করতেন। এর মধ্যে র্যাব সাহিদাকে গ্রেপ্তার করেছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, টিকটক হৃদয় অনলাইনে টিকটক ও বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া গ্রুপের তরুণীদের টিকটক মডেল বানানো এবং অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত করাত। তাদেরকে পাশের দেশে বা উন্নত দেশে বিভিন্ন মার্কেটে, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বস রাফির মাধ্যমে পাচার করা হতো। অবৈধ উপায়ে তাদেরকে সীমান্ত পার করে নেয়া হতো। পাচারের পর তাদেরকে বিভিন্ন নেশা করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করত।
রাফি চক্রের মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
সম্প্রতি ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশে নারী পাচার এবং বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের পাচার চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। টিকটক হৃদয় টিকটক ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে একটি গ্রুপ খোলে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তরুণীদের মডেল বানানোসহ ও বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টিকটক হৃদয় আকৃষ্ট করত। পরে পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন সুপারমল, সুপার শপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেয়ার কথা বলে দেশ থেকে তরুণী ও নারীদের বস রাফির সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করতো। পার্শ্ববর্তী দেশের তাদের পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউজে নেয়া হতো।
নারী পাচার চক্রের মূল বিষয় তুলে ধরে খন্দকার আল মঈন বলেন, ভারতে ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা গত ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক বাবুসহ অজ্ঞাতনামা আরো চারজনকে আসামি করা হয়। নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি এ জাতীয় ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষিতে র্যাব ওই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার (৩১ মে) থেকে মঙ্গলবার (১ জুন) পর্যন্ত র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ও র্যাব-৩ এর অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেমে নারী পাচার চক্রের মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার রাফি জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ভারতে কিশোরগঞ্জের নির্যাতিত ওই নারী দুজন বাংলাদেশি নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করায় তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়। তাকেও বলা হয়, সে যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ধারণ করা ভিডিওটি স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। বিগত ৮ বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার গমনাগমন রয়েছে। সে সেখানে কখনো ট্যাক্সি ড্রাইভার, কখনো হোটেল রিসোর্ট কর্মচারী আবার কখনো কাপড়ের ব্যবসা করত। সে বিগত ৫ বছর যাবত নারী পাচারের সাথে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটকের মাধ্যমে হৃদয়ের সঙ্গে বস রাফির পরিচয় হয়। সে টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করেছে। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্টও রয়েছে।
গ্রেপ্তার বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার একাধিক বিয়ে হয়েছিল। ম্যাডাম সাহিদা ও তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছে বলে সাহিদা জানিয়েছে।
ভাইরালকৃত ভিডিওতে তানিয়াকে সহাযোগী হিসেবে দেখা গেছে। সাহিদা বাংলাদেশ এলাকায় একটি সেফ হাউস পরিচালনা করত। সেফ হাউজে বিভিন্ন নারী সংক্রান্ত অবৈধ কার্যক্রম করা হয়। এ অবৈধ ব্যবসায় সে দীর্ঘ ১০ বছর যাবত জড়িত। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ মূলহোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকে। তারাও বর্ণিত নারী পাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ম্যাডাম সাহিদা সম্পর্কে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ম্যাডাম সাহিদা গত ১০ বছর ধরে ভারতে মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। যশোরের সীমান্ত এলাকায় সাহিদার তত্ত্বাবধানে একটি সেইফ হাউজ রয়েছে। এছাড়া বেনাপোল সীমান্তে বিভিন্নভাবে মানবপাচারে সহায়তা করেছে।
দালালরা সীমান্ত কীভাবে ম্যানেজ করত সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দালালরা যশোরের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করত। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। সীমান্তে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল থাকত তখন পাচারকারীরা নারীদেরকে পাচার করত। অনেক সময় কাটাতারের ব্যারা কেটে ভারতে পাচার করা হতো।