রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি শের-ই-বাংলা প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে তাঁর গৌরবের ইতিহাস

রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি শের-ই-বাংলা প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে তাঁর গৌরবের ইতিহাস

আবুল কাশেম ফজলুল হককে চেনাতে কষ্ট হবে। কিন্তু বাংলা বাঘকে চেনাতে কি কোন কষ্ট হবে। আবুল কাশেম ফজলুল হক বললে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কে এই ব্যক্তি। কিন্তু এই নামের আগে যদি শের-ই-বাংলা ব্যবহার হয়, তাহলে আর শিশু থেকে বৃদ্ধ কাউকে বলে দিতে হবে না তিনি কে। সবাই একবাক্যে বলে উঠবেন বাংলার বাঘ শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক। যিনি আমাদের গর্ব ও অহংকারের প্রতীক। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রবক্তা, প্রজাস্বত্ব আইনের প্রবক্তা, অভিবক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কৃষকের নয়নমনি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক। তখনকার ভারতবর্ষের অনন্য এই মানুষটিকে রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি বললেও কম বলা হবে। মহান কীতির এই মানুষটির জন্মক্ষণে আমরা তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

যিনি আমাদের মুক্তিদাতা, তাঁর মূল্যায়ন কই? কালের পৃষ্ঠায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এই সমস্ত অর্জন। দেশে কিছু প্রতিষ্ঠানের নামকরণ ছাড়া তাঁর কর্মময় জীবনের খুব ক্ষুদ্র অংশ জনসম্মুখে আসছে। ফলে আমাদের সন্তানরা শের-ই-বাংলাকে সেভাবে জানে না। তাদের সামনে শের-ই-বাংলাকে তুলে ধরার উদ্যোগও তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের সামনে শের-ই-বাংলাকে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে আমাদের অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। তাই বর্তমান প্রজন্মের মাঝে শের-ই-বাংলার অবদান ও অর্জনসমূহ তুলে ধরতেই হবে।

বাংলাদেশের অবিসংবাদিত এই মানুষটির জন্মদিন ছিল গতকাল ২৬ অক্টোবার। অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একে ফজলুল হক আমাদের মাঝে অনেকটাই উপেক্ষিত। কোনমতে তাঁর জন্মদিন পালন করেই দায় শেষ করে সরকার। দেশের অনেক স্থানেই তাকে স্মরণও করা হয় না। বাংলাদেশের অবদানের কথা উঠলেই যে কয়টি নাম উচ্চারণ হয় শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক তাদের মধ্যে অন্যমত। আমরা চাই, তাঁকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সবিস্তরে তুলে ধরা হোক। তাঁর শিক্ষা জীবন, কর্মময় জীবন সম্পর্কে আমাদের সন্তানদের জানানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।

বর্তমান সময়ে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। মন্দিরসহ সনাতন ধর্মের মানুষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন এবং লুটপাটে সম্প্রীতির বাংলাদেশ অস্থির হয়ে উঠছে। আর এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ভারতবর্ষে। হামলা হচ্ছে মসজিদসহ মুসলিমদেরও ওপরও। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কৃষকরে জন্য নিবেদিতপ্রাণ একে ফজলুল হক এমন কোন বিষয় নেই যেখানে নিজের কর্ম ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেননি। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা ঠেকাতে ভূমিকা রেখে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে দাঙ্গা বন্ধ হয়। আজকের এই কঠিন সময়ে শের-ই-বাংলার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন।

একে ফজলুল হক এসডিও পদে চাকরি করার সময় জমিদার ও মহাজনের নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেছেন। এর প্রতিকার করতে উদোগী ভূমিকা নেন তিনি। কেবল কৃষকের কথা চিন্তা করে ১৯০৮ সালে এসডিওর পদের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা না করে তিনি সেই চাকুরীও ছেড়ে দেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে একে ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। কেবল সেই কারণে কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক সাংবাদিকতা করেছেন। নিজে বলাকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকায় কাজ করেছেন। এসময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় হুমকীর শিকার হয়েছেন। শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ ছিল তাঁর।

শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধির কাতারে নাম লেখান। এর মাধ্যমেই একে ফজলুক হকের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। এরপর আর তিনি পেছন দিকে তাকাবার সময় পাননি। একে একে তিনি আইন পরিষদের সদস্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অভিবক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক পদ অলংকৃত করেছিলেন। যেটুকু তুলে ধরা হলো এটা শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের জীবনের অতি সামান্য অংশ।

এতো এতো গুণের অধিকারী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের পূর্বপুরুষ আঠারো শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময় তারা বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার চাখারে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েন।

চাখারে তাঁর বসতভিটায় তাঁর নামে একটি জাদুঘর থাকলেও সেটা কেবল তাঁর স্মৃতিচিহ্নের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে গিয়ে পর্যটকসহ দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফেরেন। আমরা চাই, চাখারে একে ফজলুল হকের বসতভিটায় ফজলুল হক কমপ্লেক্স নির্মাণ করে শিল্পকর্ম, গ্যালারি, বৃহৎ আকারে জাদুঘর নির্মাণ করা হোক। ভাসানী নবোথিয়েটারের মতো একে ফজলুল হক নবোথিয়েটার গড়ে তোলা হোক তাঁর বসতভিটায়। তাহলে মানুষ ওই বসতভিটার প্রতি আকৃষ্ট হবে। যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের শিশু থেকে শুরু করে শেষ জীবনের সব ইতিহাস খুঁজে পাবে। তার জন্মদিনে আমরা এই গুণি ব্যক্তিত্বর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।