রোহিঙ্গাদের গ্রহণে প্রস্তুত ভাসানচর

রোহিঙ্গাদের গ্রহণে প্রস্তুত ভাসানচর। আবার কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প থেকে ৬০০ রোহিঙ্গা পরিবারকে সেখানে স্থানান্তরে প্রস্তুত স্থানীয় প্রশাসনও। তবে ভাসানচরে স্থানান্তরে রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ এবং বেশ কিছু এনজিওর কঠোর আপত্তি থাকায় প্রশাসন নীরবে কাজটি করার প্রস্তুতি নিয়েছে কয়েক দিন ধরে। কারণ যেসব পরিবার ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাদের নামধাম জানার চেষ্টা করছে ওই পক্ষটি। ভাসানচরের নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক তথ্য ছড়াচ্ছে তারা এবং ইচ্ছুক পরিবারকে ভয়ভীতিও দেখানোর চেষ্টা করছে। তাই প্রশাসন এত গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছে বলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আমাদের উখিয়া প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের নিতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে। আজ থেকে তাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে দেশ রূপান্তর জানতে পেরেছে। সকাল ১০টা থেকে তাদের নিয়ে যেতে রাখা হয়েছে গাড়ি ও ৬৬ টন খাদ্যসামগ্রী। যদিও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছে না স্থানীয় প্রশাসন।
এর আগে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপ ঘুরে আসে ২২টি এনজিও প্রতিনিধিদল। তারা সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেয়। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের এমন খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই এনজিও ও রোহিঙ্গা নেতারা সক্রিয়। তারা স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের নাম জানার চেষ্টা করছে। কোনোভাবেই যেন তারা ভাসানচরে না যায় সেই চেষ্টা করছে তারা। আবার প্রশাসনও তাদের বিষয়ে তৎপর। গোপনে তালিকা করছে এবং কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে ইচ্ছুকদের স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশাসনের কথা হলো, আগে ভাসানচরে এই স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করতে পারলে, নিরাপদ ও সুস্থ জীবন পেলে অনেকেই যেতে রাজি হবে। কিন্তু শুরু করতে না পারলে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর সম্ভব নয়। তাই এত রাখঢাক।
এদিকে ভাসানচরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন প্রাসঙ্গিক, নির্ভুল এবং হালনাগাদ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তথ্যসমৃদ্ধ এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ‘ওই স্থানান্তরের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে অথবা শরণার্থীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।’ অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে পুরো বিশ্বকে এক হওয়া উচিত।
কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম এনে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবে। ক্যাম্প-২০-এর হেড মাঝি মোহাম্মদ হোছন বলেন, ক্যাম্প-২০ এবং ২০ এক্সটেশন থেকে ৮ পরিবার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখাকালীন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওইসব পরিবার ক্যাম্পে অবস্থান করছে। ক্যাম্প-১৭-এর হেড মাঝি মোহাম্মদ নুর বলেন, তার ক্যাম্প থেকে ৭০ পরিবারের নাম দেওয়া হলেও ৯ পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। ক্যাম্প-৫-এর হেড মাঝি জাফর আলম বলেন, ওই ক্যাম্প থেকে ৫ পরিবার ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক তহিদুল আলম তহিদ বলেন, শুধু ভাসানচরে নয় পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা হোক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভাসানচরে যারা যাবে তারা অনেক স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাবে। কিন্তু কিছু কিছু এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাক। তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও চায় না। রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে ভাসানচরে। এনজিওদের ভয় হলো, রোহিঙ্গারা ভাসানচরে গেলে সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে এবং তারা অন্যদেরও যেতে উৎসাহিত করবে। তাই রোহিঙ্গা স্থানান্তরে কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে।
প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই অস্থায়ী আবাসস্থল এখন কর্মমুখর। দ্বীপটি বাসস্থানের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, মসজিদ, স্কুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য সেখানে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর পালন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধানচাষও করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১ লাখ ১ হাজার ৩৬০ জন রোহিঙ্গার জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত ভবনগুলো ভূমি থেকে ৪ ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউচে ১২টি ঘর, প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে রুম রয়েছে। এর সঙ্গে একটি চারতলাবিশিষ্ট কম্পোজিট স্ট্রাকচারের (স্টিল) শেল্টার স্টেশন রয়েছে, যা আনুমানিক ২৬০ কিলোমিটার ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড় সহনীয়। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাস ব্যবস্থা। ধর্মীয় ইবাদত পালনে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনটি শেল্টার করা হয়। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে।
সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে পরিবেশবান্ধব ভাসানচরে স্থানান্তর একটি মহতি উদ্যোগ। আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও নিরাপদ জায়গা মনে হচ্ছে ভাসানচর।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা বলেন, ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ তাদের স্থানান্তর করা হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তীতে মিয়ানমারে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করে আসছে।
জাতিসংঘের বিবৃতি : জাতিসংঘ জানায়, বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভাসানচরে প্রারম্ভিক স্থানান্তরের কাজ আগামী কিছুদিনের মধ্যে শুরু করার সম্ভাবনাবিষয়ক কিছু প্রতিবেদন সম্পর্কে তারা অবগত। যেসব শরণার্থী স্বেচ্ছায় ভাসানচরে স্থানান্তরিত হতে চাইবে সেখানে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবিকার নিশ্চয়তা এবং উক্ত দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে চলাচলের স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছে জাতিসংঘ। ‘এটি ভাসানচরে একটি কার্যক্ষম ও নিরাপদ জনপদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে’ বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশ সরকারের ভাসানচর প্রকল্পের ঘোষণার সময় থেকে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ গঠনমূলক আলোচনার প্রস্তাব রেখেছে এবং সরকারের সঙ্গে নীতিগত, পদ্ধতিগত এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিবেচনা করেছে। তবে এখনো এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ।
প্রত্যাবাসনে বিশ্বকে এক হওয়া উচিত : বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত রেনসে তেরিঙ্ক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়ে তাদের সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এক হওয়া উচিত। গতকাল বুধবার রাজধানীর এক হোটেলে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন-ডিক্যাবের সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘তারা নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যেতে চায়। আমাদের উচিত এতে সমর্থন দেয়া।’ এই বিষয়ে স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতরাও বক্তব্য দেন। প্রত্যাবাসন ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কথা বলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত। তবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘের কারিগরি কমিটির মূল্যায়নের আগে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করার কথা জানান তিনি।
ভোরের আলো/ভিঅ/০৩/১২/২০২০