রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হোক

বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ২ বছর অতিক্রম হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে এখনো কোন উদ্যোগ নেয়নি মায়ানমার সরকার। মায়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরণের কূটনৈতিক নাটক করে চলেছে। চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মায়ানমার সবশেষ গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করে। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক হয়েছিল। দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কক্সবাজারের বিপুল এলাকাজুড়ে যে সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। গত দুই বছরে তাদের একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। এখন বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
কোনকালে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনি। রোহিঙ্গাদের জমি, বিয়ে এবং সন্তান ধারণেরও স্বাধীনতা ছিল না। সবশেষ রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িসহ পুরো এলাকা পুড়িয়ে মটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। হত্যা, নির্যাতন ধর্ষণের শিকার হয়ে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সব সময় রোহিঙ্গারা কেবল মায়ানমার সরকারের আশ্রিতা হিসেবে গণ্য হয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের পরও এই ব্যাপারে মায়ানমার সরকার ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা চাই, রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হোক। একই সঙ্গে তাঁদের নিজ বসতভিটায় পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হোক।
রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিকভাবে আরাকানী ভারতীয় বলা হয়ে থাকে। রোহিঙ্গা পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। ২০১৬-১৭ সালে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় নির্যাতনের পূর্বে অনুমানিক ১ মিলিয় রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি। যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়।
১৯৮২ সালের মায়নমারের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। মায়ানমার সরকার তাদেরকে জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করাতো। সপ্তাহে একদিন করে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনী অথবা সরকারি প্রকল্পে এবং সপ্তাহে একদিন প্রহরী হিসেবে কাজ করতে হতো। এছাড়াও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের অনেক আবাদী জমি জোরপূর্বক দখল করে সেখানকার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে অথবা মায়ানমারের অন্য স্থানের বৌদ্ধদেরকে দিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারা বাস্তুভিটা হারাতে শুরু করে।
এতকিছুর পরও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়র প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৫ সালে। বার্মার কুটনীতিকদের সাথে এক বৈঠকের পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে তারা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা ৯ হাজার রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফিরিয়ে দেবে। ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর মায়ানমারের নতুন সরকার নিবন্ধিত রেরাহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে স্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ২০১২ সালের রাখাইন দাঙ্গা এই চেষ্টাকে বিফল করে দেয়। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বাড়তেই থাকে।
২০০৫ সালেও একবার বাংলাদেশ থেকে মায়ানমারে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মায়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে সে চেষ্ট বাতিল হয়ে যায়। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পরও ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ শিবিরে বসবাস করত। জাতিসংঘের বেশ কিছু চেষ্টার পরও বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গারা ২০১২ সালের দাঙ্গার পর নির্যাতনের ভয়ে আর ফিরে যেতে চাননি। মায়ানমার সরকারের অমানবিক নির্যাতনের ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়নি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গার যে ঢল নামে তা বাংলাদেশকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজার জেলাসহ সারা দেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে উদ্বিগ্ন।
২০১৪ সালের ২৯ মার্চ বার্মা সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিষিদ্ধ করে এবং তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারেরমত ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুদের ‘বাঙালি’ হিসেবে নিবন্ধের জন্য আহ্বান করে। ২০১৪ সালের ৭ মে, যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ একটি বিল পাশ করে। যেখানে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বন্ধে মায়ানমার সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ কমিটির গবেষকরা বলেন, মায়ানমার রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
সেই চেষ্টার চূড়ান্ত মহড়া শুরু হয় ২০১৭ সালে। ওই সময় রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, হত্যা, নির্যাতন এবং ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে যায়। যুদ্ধে নিয়োজিত কোন দেশেও এমন গণহত্যা হয়নি বলে মত প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। হত্যা, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রাণ রক্ষায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সরকার তাদের মানুষের মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা চাই, মায়ানবার সরকারর দ্রুত রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাদের বসত ভিটায় ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেবে।
লেখক - সাইফুর রহমান মিরণ/ সাংবাদিক / কলামিস্ট