শহীদ আলতাফ মাহমুদ ৫২ আর ৭১ এর চেতনায় ভাস্বর এক মহামানব

বাকলা থেকে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের নামকরণ এক সময় ‘বরিশাল’ রূপ নেয়। নানা কারণে বরিশাল বিশ্বের কাছে সমাদ্রিত। ধান-নদী-খালের কারণে বরিশাল প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সশ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিতির কারণে ব্রিটিশ ও পর্তুগীজরা এখানে ব্যবসা করতে এসেছিলেন। বিশ্বে র বুকে বরিশালের মর্যাদা বাড়িয়েছেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, বীরশ্রেষ্ঠা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, মাতৃসম কবি সুফিয়া কামালসহ অনেকে। এসব পরিচয় ছাপিয়ে আজ বিশ্বের দেশে দেশে একটি সুর বরিশালের মর্যাদাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই মর্যাদার নায়ক হচ্ছেন বরিশালের কৃতি সন্তান সুরশ্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদ। শহীদ আলতাফ মাহমুদ ৫২ আর ৭১ এর চেতনায় ভস্বর এক মহামানব। গতকাল মঙ্গলবার ছিল এই মহানায়কের জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে কেবল শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, আমাদের ঋণের দায় শোধ করার দিন।
বরিশালের গর্ব এবং অহংকার করার মতো অনেকগুলো বিষয় আছে। তার মধ্যে উল্লেখযাগ্য হচ্ছে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৭৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এর বাইরে যে কোন গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বরিশাল সবার আগে ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নামও বরিশাল। সেই বরিশালের কৃতি সন্তান শহীদ আলতাফ মুহমাদের স্মৃতি আমরা রক্ষা করতে পারছি না।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’সহ অসংখ্য দেশাত্মবোধক ও উদ্দীপনামূলক গানের সুরকার ভাষা সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলতাফ মাহমুদ। বাঙালি স্বাধিকার আন্দলে বুদ্ধি ও সুর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবীত করার কারণে পাকিস্তানী বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর লাশটি পর্যন্ত পরিবার ফিরে পায়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার এবং একুশের গানের সুরকার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামে তার জন্মস্থান বরিশালে কিংবা জাতীয়ভাবে স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। আজো সেটা হয়ে ওঠেনি। উল্টো তার স্মৃতি রক্ষায় বরিশালের একমাত্র স্থাপনা ও সম্পত্তি বেদখল হওয়ার পথে। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।
বরিশালের কৃতি সন্তান সাংবাদিক, লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের সময় একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। একটা কবিতা কালজয়ী ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। গাফফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত কবিতার প্রথম সুর দিয়েছিলেন বরিশালের আর এক কৃতি সন্তান শিল্পী আবদুল লতিফ। বরিশাল নগরের শ্রীনাথ চ্যাটার্জী লেনের এক বাসায় দ্বিতীয়বার সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদের সুর শুনে আবদুল লতিফ বলেছিলেন, ‘আলতাফ তোমার সুরটা ভালো হয়েছে’ আবদুল লতিফ নিজের সুর বাদ দিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের করা সুরে নিজেও গয়েছেন। সেই থেকে একুশের গানের সুরকার হিসেবে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম যুক্ত হয়। আজো বিশে^র প্রায় ২০০ দেশে একযোগে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সেই সুর কোটি কোটি কণ্ঠ ছুঁয়ে যায়। একটি গান আমাদের অমরত্ব দিয়েছে, মৃত্যুঞ্জয়ী পদক এনে দিয়েছে। আমরা সেই পদকের মূল্যায়ন কতটুকু করতে পেরেছি, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে জাতির শ্রেষ্ঠ এই মানুষদের প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
১৯৫২ সালের ভাষার জন্য সংগ্রামে বরিশালের রয়েছে অনন্য ইতিহাস। সেই ইতিহাসের অনন্য মানুষ হচ্ছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আর্ন্তাজিতক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে একযোগে সবার কণ্ঠে যে গান ধ্বণিত হচ্ছে, সেই গানের রচয়িতা এবং সুরকার দুইজনই জন্মেছেন বরিশালে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এই গানের অমর ¯্রষ্টা আবদুল গফ্ফার চৌধুরী আজো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। কিন্তু এই গানের সুরকার আবদুল লতিফ এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তাঁদের স্মৃতি হয়ে বাজছে তাদের সুর করা গান। এই দুইজনের মধ্যে শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকার বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। ধারণা করা হয় ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদকেও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলতাফ মাহমুদ অবদান রেখে বরিশালকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাঁর এই ঋণ শোধের কোন ধরণের উদ্যোগ নেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ আলতাফ মাহমুদ অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান রচনা ও পরিবেশনার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর সেসব গান তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো। এ ছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ ও খাদ্য দিয়েও প্রত্যক্ষ্যভাবে সহযোগিতা কেরছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তার স্মৃতিতে বরিশালে এবং জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তয়নে উদ্যোগ নেই। অন্তত শহীদ আলতাফ মাহমুদ আমাদের রক্তে-ধ্বমনিতে ৫২ আর ৭১ এর চেতনায় প্রবাহিত হওয়া উচিরত ।
আমরা চাই, কৃষক আন্দোলনের নেতা শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী মনোরমা বসু মাসী মা, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় অমর গানের রচয়িতা আবদুল গফ্ফার চৌধুরী, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, কবি সুফিয়া কামালসহ অসংখ্য গুণি মানুষের তীর্থস্থান বরিশালে যেন ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের অনন্য সুরশ্রষ্টা, ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্মৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হয়।