শিশুকে চার দেয়াল থেকে মুক্তি দিন, মুক্ত বাতাসে বেড়ে উঠতে দিন
শিশুর কাঁধে বোঝা না দিয়ে, ভালোবাসায় আগলে রাখতে হবে। শিশুদের আদর্শের সঙ্গে বেড়ে ওঠানোর দ্বায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের। আজকের শিশুটি যদি আদর্শের সঙ্গে বেড়ে উঠতে পারে অবশ্যই সেই শিশুটি আগামীর দিনে একজন আর্দশ মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আজকাল দেখা যায় নিজের শিশুকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন মা-বাবারা। পর্যাপ্ত বয়স হওয়ার আগে বিদ্যালয় পাঠিয়ে দেন। বেশি বেশি বই, দিন রাত কোচিং। কাঁধে ব্যাগ ভরে বই দিয়ে অভিভাবকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। আসলে আমরাই সন্তানকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। যে শিশু কাধেঁ দশ কেজি ওজনের বই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়, প্রাপ্ত বয়সে সে কিভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াবে? আমরাইতো শিশু বয়সে তার মেরুদন্ড বাঁকা করে দিচ্ছি।
আমার শিশুটি কতটা ভার বহন করতে পারবে সেই দিকটা আমরা কখনই ভাবি না। আদরের সন্তান শিশুটির দুঃখের কথা ভাবার সময় খুবই কম। অফিস, বাসার কাজ, মার্কেট, ইত্যাদি খুটি-নাটি নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি। ভুলে যাই শিশুটিকে আদর-সোহাগ দিতে। ভুলে যাই তার মনের কথা? জানি না শিশুটি কি চায়, আর কি পায়।
পাড়া মহল্লায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখে শুনতে পাই ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষৎ’। কিন্তু আমারা শিশুদের কি সেই উজ্জল ভবিষৎ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো?
যে শিশুর উঠানে, বাসার ছাদে, মাঠে বসে খেলাধূলা করার কথা। সে তারবিহীন যাদুর বাক্সে বন্দি হয়ে যায় শিশু বয়সে। এই দায় কে নেবে? শখের বসে হাতে মোবাইলটি তুলে দিয়ে আমার শিশুকে ঠেলে দিচ্ছি নরকে। শেষ বয়সে এসে এই নরক যন্ত্রণা আমাদেরই পোহাতে হয় কি না। সে বিষয় কোন সন্দেহ আছে কি?
যাদের নব্বইদশক বা তার আগে জন্ম তাদের নিশ্চই মনে আছে। ছোট সময় যখন কান্না করতাম বাবা মা তখন মাটির তৈরি পুতুল কিংবা পশু পাখি দেখিয়ে শান্ত করতেন। সেই মাটির পুতুল দেখতে দেখতে এক সময় আমরা নিজেরাই মাটির পুতুল তৈরি করতে শিখে যেতাম। পশু পাখির নাম মুখস্ত করতাম। চক দিয়ে সিলেটে আঁকতাম শখের দোঁয়েল পাখি, জাতীয় মাছ ইলিশের ছবিটি। এভাবেই আমরা গড়ে উঠতাম।
আজ আমাদের শিশুর কান্না পেলে হাতে ধরিয়ে দেই মোবাইলের গেমস অথবা সামনে চালিয়ে দেই মোবাইলে ভিডিও। একদিন শিশুটির অভ্যাস হয়ে যায় মোবাইলটি হাতে নেয়ার। দেখা যায় তার হতে মোবাইল না পেলে ঘুমতে যাবে না। কি আর করার তখন নিজের ভিতর বিরক্তি লাগলেও শিশুকে ঘুম পারাতে হলে মোবাইলটি তার হতে দেই।
কিন্তু, ঠিক এই বয়সটায় আমার ঘুম না পেলে মা আমাকে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো-
‘ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি মোদের বাড়ী এসো
খাট নাই পালং নাই চোখ পেতে বস
বাটা ভরা পান দেব গাল ভরে খেয়ো
বিন্নি ধানের খই দেবো আঁচল পেতে নিও...
খোকার চোখে ঘুম নেই, ঘুম দিয়ে যেও’
ছড়া শুনতে শুনতে একটা সময়ে আস্তে করে ঘুমিয়ে যেতাম মায়ের কোলে। আর মাও শান্তি পেত আমাকে ঘুম পাড়িয়ে।
আজ আমাদের শিশুর সঙ্গে আমরা যদি অন্যায় করি। তার ফল তো একদিন আমাদেরই ভোগ করতে হবে। শিশুর কাঁধে বোঝা দিলে মেরুদন্ড তো অবশ্যই বাঁকা হবে। সারারাত জেগে বই পড়ালে ১৬ বছর পেরনোর আগেইত দুচোখ আবছা হবে। এর ব্যতিক্রম কিছুই নেই।
আমাদের সজাগ হতে হবে। শিশুর প্রতি সহনশীল হতে হবে। ভালোবাসা দিতে হবে। কাঁধের ওজন কমিয়ে শিশুকে আপনার কাঁধে নিতে হবে। মোবাইলে গেইম খেলতে না দিয়ে তার সঙ্গে আপনি খেলতে পারেন। আপনি গান শুনাতে পারেন, ছড়া শোনাতে পারেন। এই বয়সে যেভাবে আপনি তাকে গড়ে তুলবেন সেভাবে শিশুটি বেড়ে উঠবে।
শিশুদের খেলার মাঠ ঘরের বারান্দা নয়, মাঠে নিয়ে যেতে হবে। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে হবে। নিশ্চই আপনার সন্তান, আপনার শিশু, আপনার ভবিষৎ মুক্ত চিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠবে এবং আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে।