শিশুরা ধূমপান না করেও ধূমপায়ী

‘সিগারেটের ধোঁয়া যখন আমার নাকে আসে, তখন বেশ অস্বস্তি লাগে, কেমন যানি দম বন্ধ বন্ধ মনে হয়। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়’- কথাগুলো বলছিলো শিশু সানজিদা। সানজিদা নগরির একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সানজিদার সাথে দেখা হয় ওদের স্কুলের খেলার মাঠে। স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের সাথে খেলছিল ছট্ট এই শিশু। কৌতুহল বশত সানজিদা ও তার বন্ধুদের সাথে কথা হয়। ওদের সবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পকানো ধারইা আছে কি না? প্রশ্নটা শুনে সবাই চুপচাপ থাকলেও একমাত্র সানজিদাই জানায় ওর অস্বস্তির কথা। না ধূমপানের কুফল সম্পর্কে শিশুটির কোনো ধারইা নেই। তবে সে জানায়, তার বাবা প্রায়ই ঘরের মধ্যে ধূমপান করে। হাজারবার নিষেধ করলেও বারই শুনে না। সানজিদা অভিযোগ করে বলে- ‘যখন বলি বাবা সিগারেটের ধোঁয়ার কারণে মাথা ঘুরাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, রুমের মধ্যে সিগারেট না খেলে হয় না? বাবা তখন বলে, এইত মা এই শেষবার আর সিগারেট খাব না। কিন্তু বাবা কথা রাখেন না, একই কাজ প্রতিদিনই করেন’। সানজিদার কথা শুনে খারাপ লাগলেও একদমই অবাক হইনি। কারণ অনেক বাবাই শিশুদের সামনে প্রকাশ্যে ধূমপান করের। শুধু বাসা-বাড়িতে নয়, রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকে দেদারসে ধূমপান করেন। এই সব ধূমপায়ীরা সিগারেট খেয়ে যে ধোঁয়া ছাড়ে তা আশেপাশে থাকা লোকজনের নাকে-মুখে ও শরীরে অনায়াসে প্রবেশ করে। যেটা কি না মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে মারাত্বক ক্ষতিকর পদার্থ নিকোটিন। বিষাক্ত নিকোটিন মানব শরীরে প্রবেশ করলে মানুষের ক্রমশ মৃত্যুর দিকে নিয় যায়। বাড়ায় নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি যৌথ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশেপাশের এলাকার ৯৫ ভাগ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর এর কারণ হচ্ছে পরোক্ষ ধূমপান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভারসিটি অব ইর্য়ক, ইউনিভারসিটি অব এডিন বার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে এই গবেষণা করে। গবেষণাটিতে ১২টি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সব শিশুদের অধিকাংশর বয়স ১১-১৩ বছরের মধ্যে। গবেষণায় শিশুদের লালা পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৪৭৯ জন শিশুর মধ্যে ৪৫৩জন শিশুর লালায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৯৫ ভাগ শিশু। ধূমপান না করে এসব শিশুরা মারাতœক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। এ বিষয় কথা হয় বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেজ্ঞ ড. মকসুদ আহাম্মেদের সঙ্গে। তিনি বলেন-‘পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুর নিউমনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস, ব্রংকাইটিস, হাপানির মত রোগ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও পরিণত বয়সে এদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বেড়ে যায় এবং ব্যাহত হতে পারে তাদের স্বাভাকি বেড়ে ওঠা ও মানষিক বৃদ্ধি’। তিনি বলেন, কেবল শিশুর জন্মের পরেই নয়, আগেও মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় পরোক্ষ ধূমপান ক্ষতির কারণ হতে পারে। চিকিৎসক বলেন, পরোক্ষ ধূমপান শিশুর ভ্রƒণের বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়াও গর্ভপাত কিংবা অপরিণত শিশুও জন্ম নিতে পারে। জন্মের পরে এসব শিশু স্বাশকষ্ট ও মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাক জাত দ্রব্য আইন’ আরও শক্তিশালী করে ২০১৩ সালে সংশোধন করে। নতুন আইনের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী সকল তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী সম্প্রতি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বিভিন্ন ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ছবিগুলোর মাধ্যমে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, যেনে বুঝেও অনেকে ধূমপান করে যাচ্ছেন। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কথা হয় বরিশাল জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা পংকজ রায় চৌধুরীর সাথে। তিনি সকল ধূমপায়ীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন-‘শিশুর শারীরিক ও মানিসিক বৃদ্ধির সময় তার পাশে ধূমপানের মত কাজ থেকে বিরত থাকা না গেলে তার আগামীর দিন খুব ঝুঁকিপূর্ণ এটা নিশ্চিত। যদি কেউ প্রকাশ্যে ধূমপান করে এবং তার পাশে যদি কেউ থাকে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় উভয়েই। তাই সকল বিষয় বিবেচনা করে আমরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় ধূমপান বর্জন করি এবং ধূমপানমুক্ত সমাজ গড়ে তুলি’। লেখক: শিশু সাংবাদিক