সম্প্রীতি রক্ষায় প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে

শিশু থেকে বড় হতে হতে শিখেছি নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখো। একই সঙ্গে অন্যের ধর্মকে ঘৃণা করো না। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠো। কিন্তু কোন ধর্মকে খাটো করে নয়। তুমি তোমার ধর্ম পালন করো। অন্যকে তার ধর্ম পালন করতে দাও। বড় হয়ে শিখেছি বাংলাদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ একজন অন্যজনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার সঙ্গী। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের উৎসব-পার্বনে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা আমাদের দীর্ঘদিনের চেনা পরিচিত রূপে কালো তিলক এঁকে দিতে চায়। সেটা কখনো সাম্প্রদায়িক উস্কানী, ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টিসহ নানা উদ্যোগ। বাংলাদেশের মানুষ সেগুলো মোকাবেলা করে আবারো সম্প্রীতি অটুট রাখতে চেষ্টা করে চলে।
রামু, নাসির নগর, ঢাকা, ভোলার পর এবার কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলো। প্রতিটি ঘটনার পরম্পরা আছে। এই ঘটনাগুলো ঘটানোর মূল কারণ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে বিতর্কিত করা। কুমিল্লার পূজা মন্ডপে মূর্তির পায়ের নীচে নাকি হিন্দুরা কোরআান শরীফ রেখেছে। বুকে হাত দিয়ে বলুনতো এটা কি আপনাদের বিশ্বাস হয়? যদি বিশ্বাস করেন, তবে আর কিচ্ছু বলার নাই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অসম্ভব! কোন অমুসলিম এই কাজটা করার সাহস পাবেন? এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কাউকে দিয়ে তারাই এ কাজটা করিয়েছে, যেন মন্দিরে হামলা করতে সুবিধা হয়। যেন দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে সুবিধা হয়। কোথায় আছি আমরা?
নাসিরনগর মন্দির ভাঙ্গার হোতা নাকি নৌকা প্রতীকও পেয়েছে। তাহলে কোথায় সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার আওয়ামী লীগ? কেন কঠোর হাতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। এর ফল কেবল সনাতন ধর্মের মানুষরাই নয়, এর ফল আপনাদেরও ভোগ করতে হবে।
কুমিল্লা শহরের নানুয়া একটা আবাসিক এলাকার এই ম-পটা অস্থায়ী। শুধু দুর্গা পূজা উপলক্ষে ১০ দিনের জন্য বানানো হয়। পূজা শেষ হবার পরেই আবার ম-প ভেঙে ফেলা হয়। ধর্মীয় উগ্র মানসিকতার একদল এই ম-পে যাতে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতে না পারে সেই জন্যই এমন নাটক সাজিয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। ধর্মীয় উন্মদনা সৃষ্টিকারীরা সফলভাবে ধর্মীয় উসকানী দিয়ে প্রথমে মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙচুর করে পাশে দিঘিতে ফেলে দিয়েছে। পরে ধর্মের দোহাই দিয়ে সনাতন ধর্মের যাকে পেয়েছে তাকেই মারধর করেছে। এর চেয়ে জঘন্য ঘটনা আর কি হতে পারে।
পৃথিবীর দেশে দেশে সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানাছলে হামলার ঘটনা ঘটে। আজ হয়তো বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাধিক্য হওয়ার দাপটে এমনটা করেছে। কিন্তু যারা এমন জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন মিয়ানমারে সংখ্যাধিক্য কারা। তাদের বর্বরতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ রোহিঙ্গাদের। ওই দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠরা যদি ভেবে দেখতো পৃথিবীর দেশে দেশে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যলঘু হিসেবে বসবাস করছে। তাহেলে এই অবস্থা হতো না। আজকে বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বাস। কিন্তু ভারতে কেবল মুসলিম জনসংখ্যা আছে ২০ কোটির মতো। তারা কিন্তু সেখানে সংখ্যাগুরু। ১০০ কোটি মানুষের দেশ ভারত। বেশিরভাগ মানুষ সনাতন ধর্মের। এটা কেবল ধর্মীয় উসকানীদাতাদের স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য। কোনভাবেই অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, মানুষ হত্যা কাম্য নয়। সেটা সংখ্যা গরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যা লঘিষ্ঠ করো জন্যই সুসংবাদ বয়ে আনে না। এটা কেবল মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণ চিন্তা পরিহার করে মানবিক মূল্যবোধের কথা ভাবা অতি জরুরী।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মূল শ্লোগন ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখা। তার ভিত্তিতেই দেশ স্বাধীন হয়। গোটা দুনিয়ায় বাংলাদেশ সম্প্রীতির বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সরকারের মূল ঘোষণা ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ আবার ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। পৃথিবী জুড়ে যখন করোনা জয়ের মন্ত্রে বিশ^ মানবতার কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় শারদীয় দুর্গোৎসব বন্ধে মন্দিরে কোরআন শরীফ রেখে হামলা, ভাংচুরের ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে এ কোন আলামত! ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে কারা এমন সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার জন্য মাঠে নামছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কঠিন ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল নৃগোষ্ঠী বাস করছে। যার যার ধর্ম অনুযায়ী তারা উৎসব পালন করছে। রাষ্ট্র এবং সংবাধিন আমাদের সেই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু মন্দিরে কোরআন শরীফ রেখে ফায়দা লোটার চেষ্টা অশুভ চিন্তার ফসল। যারা এই কাজে নেমেছেন তারা ইসলামের দোহাই দিলেও কোনভাবেই ইসলামকে সমৃদ্ধ করছেন না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের দোহাই দিয়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা যারা করবে তাদের দৃঢ়তার সঙ্গে থামিয়ে দিতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।
যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের উৎসব বন্ধ করতে চান তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রশ্নের মুখে পড়বে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। আমরা চাই আমাদের সম্প্রীতি যেন অটুট থাকে।
যেভাবে রাজশাহীতে একই প্রাঙ্গনে পূজা ম-প এবং মসজিদ নির্মাণ হলেও কোন ধরণের ধর্মীয় অনুভূতি বিনষ্ট হয়নি। যার যার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সেখানের ধর্মপ্রাণ মানুষ মসজিদে নামাজ আদায় করছেন আবার মন্দিরে পূজা করছেন। বৃহৎ দুই ধর্মের মানুষের সেখানে কোন ধরণের সমস্যা হচ্ছে না। তারা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ নীতিতে বিশ^াস করে যার যার ধর্ম পালন করছেন। কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন রেখে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিষয়টি অবশ্যই ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।
আমরা সবাই মিলে যেন বিশ^ ধর্ম, বিশ^ মানবতার জয়গান গাইতে পারি। তাহলেই বাস্তব রূপ নেবে সম্প্রীতি। তাহলেই ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ কিংবা ‘ ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। ‘অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠা হোক শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় বিচারের আগে যেন আমরা বিশ^ মানবতার জয়গান গাইতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপ নেবে এটা আমাদের দৃঢ় বিশ^াস।