সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে

শুভ বিজয়া। প্রকৃতি থেকে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে ধরায় এসেছিলেন দেবি দুর্গা। যুগে যুগে তিনি অসুর রূপধারী আঁধার বিনাশ করে নির্মল ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য স্নিগ্ধ আলোর পরশ দিয়ে যান। আজ সেই দুর্গতিনাশিনী দেবি দুর্গার চলে যাবার দিন-ক্ষণ। এবছর দেবি দুর্গার কাছে ভক্তরা বিশ্ব মহামারী করোনা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশেষ প্রর্থণা করেছেন। আমরা আশা করি করোনা মুক্ত একটি সুন্দর পৃথিবী আমরা পাবো। আবার পৃথিবী বিশ^মানবতার গানে মুখরিত হবে। দেবি দুর্গা আমাদের সেই আশীষ দেবেন এটা প্রত্যাশা করি।
শারদীয় দুগোৎসব কিংবা দুর্গা পূজা সনাতন ধর্মের সর্ববৃহৎ উৎসব। ধর্মীয় আচার সনাতন ধর্মের হলেও এই উৎসবের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের মানুষেরও সম্মিলন ঘটে। সম্প্রীতির সবুজ ক্যানভাস আমাদের বাংলাদেশ। ঈদ-পুজা পার্বনে এখানের মানুষ একজন অন্যজনের সঙ্গে মিলিত হয় প্রাণখোলা হাসির বন্যার মতো। কিন্তু কখনো কখনো কেবল ধর্মকে ব্যবহার করে সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করা হয়। ধর্ম দিয়ে একজন মানুষ অন্য আর একজন মানুষকে জব্দ করতে চায়। অথচ ধর্ম হচ্ছে বিশালতায় পূণ একটি জীবনাচার। সেখানে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই। কেবল স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। এই বিভেদ কোন ধর্ম সৃষ্টি করে না। করে ধর্মের অনুসারী কিছু মানুষ। তাদের চিহ্নিত করে আমাদের সম্প্রীতির সেতু নির্মাণে আরও সক্রিয় হতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ও সম্প্রীতির ভীতের ওপর ভর করে। সেই সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা কোনভাবেই হতে দেওয়া যায় না। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ খুদ্র নৃগোষ্ঠী যেন যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে সেব্যাপারে সব নাগরিকের ভূমিকা থাকা দরকার। ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মানব জাতিকে রক্ষায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। একজন অন্যজনের পরিপূরক। সব ধের্মের মানুষের মূল্যায়ন ছাড়া সম্পূর্ণ কিংবা ষোলআনা মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার জন্য আহ্বন জানিয়ে গেছন কাজী নজরুল ইসলাম। সর্বোচ্চ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। একজনের আস্তিনের খঞ্জর আর অন্যজনের ত্রিশুলের ফলা যেন ধর্মের নামে মানুষে রক্ত ঝরাতে উত্তোলন করা না হয়, সেই আহ্বানও ছিল তার। সব ধর্মের মূল মন্ত্র যেন হয় অশুভ শক্তি বিনাশ করতে।
যারা সুন্দর নির্মল পৃথিবীকে ধর্মের নামে বিভক্ত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ম-বর্ণ এবং গোত্র বিবেচনায় নয়, সম্প্রীতির দৃঢ়তায় একসঙ্গে কাজ করেতে হবে। সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে সবার আগে মানুষের মূল্যান করতে হবে। কোন সংকীর্ণ চিন্তা এবং ধর্ম দিয়ে যেন এই সম্প্রীতি নষ্ট না হয়। সবাই মিলে সোনার বাংলায় এই সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করতে হবে। আমাদের লাল-সবুজের পতাকা কেবল কোন একটি ধর্মের মানুষের অর্জন নয়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই মানচিত্রের সঙ্গে মিশে আছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈনসহ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কষ্ট, শ্রম, ঘাম আর রক্ত। তাই লাল-সবুজের পতাকা একক কারো নয়, এটা আমাদের অর্জন। এতবড় অর্জনকে যেন কোনভাবেই ধর্ম দিয়ে ভাগ করা না হয়।
আমরা বলতে চাই, ধর্ম থাকতেই হবে। কারণ ধর্ম মানুষকে পরিশিলীত করে। ধর্মের অনুশাসন মানুষকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা দেয়। প্রত্যেক মানুষ তার অন্তরে ধর্মকে লালন করুক। কিন্তু কোনভাবেই যেন সেই ধর্ম অন্য ধর্মের মানুষকে ছোট না করে। আঘাত না করে, কষ্ট না দেয়। অন্তরের ভেতর যে ধর্মের বীজ বপন করা আছে এক মুহূর্তে সেটার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকা দরকার। একই সঙ্গে এক ধর্মের আয়োজনে অন্য ধর্মের মানুষের সহযোগিতাও প্রয়োজন। সব ধর্মের মানুষ সহযোগী হয়ে পাশে থাকলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। যার প্রমাণ আমাদের বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল বড় বড় অর্জন। আগে আমদের মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। নিকটতম প্রতিবেশীকে একান্ত আপন হিসেবে দেখতে হবে। এর পর যদি প্রয়োজন পড়ে তখন যেন ধর্মের হিসাব করা হয়।
আমরা বলতে চাই, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এবং ‘ধর্ম যার যার, রাস্ট্র সবার’ এই মূলমন্ত্র কেবল কথায় নয়, অন্তর দিয়ে বিশ^াস করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হলে কোন অশুভ শক্তি আমাদের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। আমাদের ভেতরে এই সম্প্রীতি বজায় থাকুক শুভ বিজয়ায় এটাই প্রত্যাশা।