সাংস্কৃতিক সংগঠক শান্তি দাস আর নেই

বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি, গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য শান্তি দাস আর নেই। তিনি গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় ফকিরবাড়ি সড়কের বাসায় শেষ নিঃশ্বস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পুত্র এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
শান্তি দাসের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাতেই তাঁর বাসভবনে ছুটে যান, সাংস্কৃতিক সংগঠক, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। বুধবার ১০টায় তাকে বরিশাল মহাশ্মশানে সমাহিত করা হয়।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শান্তি দাস বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন পরিচিত নাম। দীর্ঘদিন তিনি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন। তিনি বরিশাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একনিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চায় নিবেদিত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি গণশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটিসহ বরিশালের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শান্তি দাস কাজ করে গেছেন। রাজনীতি সচেতন শান্তি দাস বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জাড়িয়ে থেকে সাধারণ মানুেেষর মুক্তির লক্ষে কাজ করেছেন। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গিয়ে সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা এমপি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহ, ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল আনাম শাকিল, কল্পনা আনাম, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, গণশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদ, বরিশাল নাটক, খেলাঘর, শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার, পঞ্চসিঁড়ি গ্রুপ থিয়েটার, খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার, নজরুল জোট, নাট্যম, প্রান্তিক, সরলহরী, অনির্বাণ, বরিশাল শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবত প্রেসক্লাব, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
১৯৪৮ সালে ১২ জানুয়ারী বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের বদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন শান্তি দাস। কৃষিকাজের পাশাপাশি তাঁর পিতা আয়ুর্বেদিক ও কাকা এ্যালেপ্যাথিক ডাক্তার হিসেবে গ্রামের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতেন। ৬ ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শান্তি দাস। পঞ্চাশের দাঙ্গার সময় তার পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে অধ্যায়নের সময়ে তিনি বিডি হাবিবুল্লাহ পল্লী মঙ্গল নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সময় বিদ্যালয় ও এলাকায় নাটক, আবৃত্তি ও খেলাধুলার কার্যক্রম চালিয়ে যান।
১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করে তিনি এলাকায় শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। শিক্ষকতার পেশায় সততা, স্বচ্ছতা ও আদর্শ শিক্ষকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শান্তি দাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী অবস্থায় তিনি এমএ (বিএড-সি এন এড) ডিগ্রী অর্জন করেন। শান্তি দাস গ্রামে ছাত্রাবস্থায় কমরেড সোলায়মানের অনুপ্রেরণায় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর এলাকায় তিনি প্রগতিশীল বামধারায় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে সংঘঠিত করতেন। ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুথনে শান্তি দাস তার নিজ এলাকায় আন্দোলনে যুক্ত হন।
১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে এলাকায় আব্দুল বারেকের (সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) নেতৃত্বে যুব সমাজ স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। শান্তি দাস তাদের একজন হয়ে এলাকায় এলাকায় জনসচেতনতাসহ মানুষকে সংঘঠিত করার কাজে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি এলাকার রিলিফ কমিটি সদস্য হিসেবে আত্মমানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে কোন দিন নিজে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করেননি।
১৯৭৩ সালে শান্তি দাস বরিশালে বদলী হয়ে আসেন। মহাবাজের সরকারি উলালঘুনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীকালীন তিনি শিশু সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছায়াবিথী খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি শিশু সংগঠন চাঁদেরহাট জেলা সাংগঠনিক কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি পরিচ্ছন্ন বাম রাজনীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ’৮০ দশকের শুরুতে গড়ে ওঠে সৃজনী নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন শান্তি দাস।
৮২ সালে সৃজনী বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা বরিশাল শাখা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তিনি গণশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং আমৃত্যু তিনি এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি শান্তি দাস একজন শিক্ষক নেতা হিসেবেও সমধিক পরিচিত। তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভিন্ন সঙ্কটকালীন অবস্থায় বরিশালে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ০৫ সালে চাকুরী থেকে অবসরের সময় তিনি বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি ছিলেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি অধিকাংশ সময় নেপথ্যে থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অবসরের পর তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পর্টিতে থেকে সক্রিয় রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি ’৭১এর ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক; সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১’র বিভাগীয় কমিটির সদস্য। শান্তি দাস নজরুল সাংস্কৃতিক জোট বরিশাল এর সভাপতি এবং বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সদস্য। সমন্বয় পরিষদের তিন দশকের আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ব্যাপক অবদান রেখেছেন।