স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: বাংলাদেশের বাস্তবতা ও নাগরিকের করণীয়
প্রেক্ষাপট: বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিস্ময়করভাবে আলোচিত। আবার এও সত্য যে, বাংলাদেশ অনেক নেতিবাচক শিরোনামেও জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশকে বার বার সতর্ক করে আসছে বিগত বছরগুলোতে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অণুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা’র কথা। যেমন: ৩৯।
(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
কিন্তু ২০২১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ‘উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে।’
মত প্রকাশের স্বাধীনতাই যেখানে ক্ষুন্ন হচ্ছে সেখানে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতারও যে ঘাটতি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আর কে না জানে যে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিবিড় যোগসূত্র এবং এসব কিছুরই মূল প্রোথিত রয়েছে সুশাসন ও গণতন্ত্রের জঠরে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বাংলাদেশের অবস্থা বিচারে আমরা প্রেক্ষাপট হিসেবে নিম্নোক্ত সূচকসমূহকে ধর্তব্যের মধ্যে রেখে পরবর্তী আলোচনা করতে চাই:
ক) বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত বাক্ স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতায় বাংলাদেশের স্কোর ২৬.৫৭ (১০০’র মধ্যে)।
খ) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ২০২১ সালে প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭-তম (১৮০টি দেশের মধ্যে)।
গ) ফ্রিডম হাউস কর্তৃক ২০২১ সালে প্রকাশিত বাক্ স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৩৯ যা ২০১৭ সালে ছিল ৪৭ (১০০’র মধ্যে)।
ঘ) রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার কর্তৃক প্রকাশিত ২০২১ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২-তম।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : সুশাসনের মূল চাবিকাঠি
যে কোনো রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসকল প্রপঞ্চসমূহকে মৌলিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে তার মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অন্যতম। সুশাসন কিংবা গুড গভর্ন্যান্স বিশ্বব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত একটি ধারণা, যা ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রেসক্রিপশন’ নামেও পরিচিত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যা আবশ্যকীয় বলে স্বীকৃত এবং এটি একটি অংশগ্রহণমূলক শাসন-ব্যবস্থা। কোনো দেশে সুশাসন রয়েছে কিনা তা জানতে হলে প্রথমেই প্রশ্ন তোলা হয়ে থাকে যে, রাষ্ট্রটি যে সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আসলে কতটুকু রয়েছে। এবং এর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে আইনের শাসন। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থায় এগুলো সবই কেবল প্রযোজ্য তাই-ই নয় বরং এগুলোর অনুপস্থিতি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রটি ক্রমাগত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হতে শুরু করে।
সুশাসনের এই প্রাথমিক উপাদান স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হলো:
ক) স্বচ্ছতা হচ্ছে আইন ও নীতি মেনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
খ) স্বচ্ছতার সঙ্গে গৃহীত নীতি সম্পর্কে সকল নাগরিক অবহিত থাকবে এবং নাগরিকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ তাতে থাকতে হবে।
গ) একটি স্বাধীন গণমাধ্যম তথ্য প্রচারে অকুতোভয় থাকবে।
ঘ) সরকার ও বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানের নাগরিকের কাছে জবাবদিহিতার দ্বারা দ্বায়বদ্ধ থাকবে।
ঙ) জবাবদিহিতা সে অর্থে সকল উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে।
চ) রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার অভাব থাকলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ছ) রাজনৈতিক জবাবদিহিতার অভাব থাকলে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।
জ) রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা দুর্ণীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা অর্জনে নাগরিক সমাজের ভূমিকা শীর্ষক ‘ফাকাস গ্রুপ ডিসকাশন’
আলোচনা-১
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা শীর্ষক প্রথম ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনটি গত ১৭ নভেম্বর ২০২২ তারিখে আর্টিকেল নাইনটিন আয়োজন করে জুম প্ল্যাটফরমে। বিষয়বস্তু বিচারে আলোচকগণ নিম্নোক্ত বিষয়ে আলোকপাত করেন:
কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র হতে হলে বাংলাদেশকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়া এই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে। উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যেতে চাইলে বাংলাদেশকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ‘
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বাংলাদেশের অবস্থান’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারের আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক শেখ মো. মনিরুজ্জামান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহকারী পরিচালক ও টেলিভিশন সংবাদ পাঠিকা তামান্না মুস্তারী মৌ, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাহাদুর রইচুর রহমান এবং ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী ও ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’র সভাপতি জয়া সিকদার। আর্টিকেল নাইনটিনের পরামর্শক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
মূল প্রবন্ধে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হলো সুশাসন তথা আইনের শাসনের মূল উপাদান। বাংলাদেশ আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ কম, অপপ্রয়োগ বেশি।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইন একটি জনকল্যাণমূলক আইন। অথচ তথ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতে এই আইনের কার্যকর ভূমিকা ও প্রভাব নেই। বিপরীতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করবে ভাবা হয়েছিল। কার্যত দেখা গেলো- এই আইনের কারণে নাগরিকদের; বিশেষ করে সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আইন ও নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা এবং তা বাস্তবায়নে জবাবদিহিতার বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নত
রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগুচ্ছে। তাই সকল স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে। তথ্য অধিকার আইন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার বাস্তবায়ন তারই অংশ।’ তিনি আরও জানান, কার্যকরভাবে সেবা প্রদানের জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কার্যক্রম ’অটোমেশন’ করা হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহকারী পরিচালক ও টেলিভিশন সংবাদ পাঠিকা তামান্না মুস্তারী মৌ বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল-কলেজে ভর্তি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সরকার সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে অনলাইনে আবেদন শেষে ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে বিতর্কমুক্তভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে।’
এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাহাদুর রইচুর রহমান বলেন, ‘স্বচ্ছতার জন্য সঠিক তথ্য পাওয়াটা জরুরি। নির্বাচনের আগে অনেক সময় অপপ্রচার ও অপতথ্য ছড়ায়। তাই সঠিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’
ট্রান্সজেন্ডার নারী ও সম্পর্কের নয়া সেতুর সভাপতি জয়া সিকদার বলেন, ‘লৈঙ্গিক পরিচয় পরিবর্তনের কারণে ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষা সনদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে হয়রানি ও নিগ্রহের শিকার হন। ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্সম্যান, ট্রান্সওমেন ও হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সমাজে নানাভাবে পিছিয়ে আছে।’
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সকলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কোন জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে একটি দেশ এগুতে পারেনা। এসডিজি অর্জন করতে চাইলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে মনে করে আর্টিকেল নাইনটিন।
আলোচনা-২
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামসহ বিভিন্ন ক্রান্তিকালে সুশীল সমাজ তথা নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নাগরিক সমাজ সক্রিয় না হলে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যায়। তাই রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও রাজনীতিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রেও নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তরুণ, নারী ও সুশীল সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কেমন হতে পারে সে প্রসঙ্গে ওয়েবিনারে আলোচনা করেন বক্তারা। গত ২৪ নভেম্বর ২০২২ তারিখে আর্টিকেল নাইনটিনের এর আয়োজনে ওয়েবিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
এ ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদ বগুড়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদার, সাবেক সংসদ সদস্য ও খালেদ মোশাররফ ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন মাহজাবিন খালেদ এবং ট্রান্স ইয়ুথ লিডার, নৃত্যশিল্পী ও ব্যাংকার সঞ্জীবনী সুধা। আর্টিকেল নাইনটিনের পরামর্শক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি ওয়েবিনারে মূল বক্তব্যে বলেন, ‘তরুণ, নারী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন সুশীল সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা ও তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাধ্য করা সুশীল সমাজের বড় অর্জন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে সকল সমস্যা এড়িয়ে যেতে চায়, সুশীল সমাজ সেই সমস্যার কথা তুলে ধরে এবং সমাধানে সোচ্চার হয়। সুশীল সমাজ সক্রিয় না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যায়।’
অনুষ্ঠানে বগুড়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘তরুণরা নিজ থেকে কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না। তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব প্রবীণদের। কিন্তু প্রবীণরা তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ নিরপেক্ষ নয়। অনেক নাগরিক সংগঠন রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ করেন।’ তিনি তরুণ, নারী ও সুশীল সমাজকে নিজ নিজ জায়গা থেকে নিরপেক্ষভাবে দেশের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
সাবেক সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ বলেন, ‘আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে রাজনীতিকদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা নাগরিক অধিকারকর্মী ও সংগঠনগুলোর কিছুটা দুরত্ব আছে।’ এজন্য তিনি নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত ইস্যুগুলোর সঙ্গে সংসদ সদস্যদের সংযোগ ঘটানোর জন্য পরামর্শ দেন।
ট্রান্সজেন্ডার নারী ও ব্যাংকার সঞ্জীবনী সুধা বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের জন্য ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়টি অবমাননাকর। আমরা কীভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে চাই, সে বিষয়ে প্রথমে আমাদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। আমরাও সুশীল সমাজের অংশ। আমাদেরকে বাদ দিয়ে নয়, অন্তর্ভুক্ত করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। কেবল তাহলেই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা সম্ভব হবে।’
আর্টিকেল নাইনটিন মনে করে, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করা নাগরিক সংগঠনগুলো পরস্পরের সম্পূরক। কর্মক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ভিন্নতা থাকলেও তাদের অভিন্ন অভীষ্ট হলো-স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাপূর্ণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের সম্মান ও সমান অধিকার থাকবে।
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত দু’টি ওয়েবিনার-আলোচনায় বাংলাদেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বর্তমান অবস্থা এবং এটি নিশ্চিতকরণে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচকগণ স্বীকার করেন যে, এদেশের নাগরিক সমাজের সক্রিয় ও শক্তিশালী অংশগ্রহণের ফলেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নিগড় ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এদেশের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনেও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেও নাগরিক সমাজের কাঙ্খিত ভূমিকা থাকবে বলে মত প্রকাশ করেন অতিথি ও অংশগ্রহণকারীরা। ওয়েবিনার দুটিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীজন, জাতীয় ও তৃণমূলে কর্মরত সাংবাদিক, লৈঙ্গিক অধিকারকর্মী, এনজিও ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ফারুখ ফয়সল যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক।