হামলাকারীদের ক্ষোভ কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে

হামলাকারীদের ক্ষোভ কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের হরতালের দিন হামলায় ক্ষত-বিক্ষত ও ধ্বংস্তূপে পরিণত হওয়া বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজির আহমেদ।

বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে দুপুর ১২টায় প্রথম সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের স্মৃতিধন্য দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন পরিদর্শন করেন। এ সময় এই সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন মনজুরুল আলম তাকে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার বিবরণসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরেন। আইজিপি এরপর সদর উপজেলা ভূমি অফিস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব পরিদর্শন করেন।

প্রেসক্লাবে আসলে সেখানে উপস্থিত প্রেসক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন তার ওপর হামলার বর্ণনা দেন। প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রহিম বিজন শহরের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডবের বর্ণনা করেন।

প্রেসক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি হরতালের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চলাকালে প্রশাসন ও পুলিশের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, প্রশাসন-পুলিশের সমন্বয়হীনতা ছিল।

এ সময় আইজিপি বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে তাণ্ডব চলেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং নৃশংসতম। এ তাণ্ডবের ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই। নারায়ণগঞ্জের এক সাংবাদিকের নাম শুনে হরতালকারীরা তাকে চারবার কলেমা পড়িয়ে নিশ্চিত হয়েছে সে মুসলমান। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের চার কলেমা পড়ে প্রমাণ দিতে হয় মুসলমানের, সেখানে কি একাত্তরেই থেকে গেলাম?’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ ইসলামের স্বার্থে, দ্বীনের খেদমতে ৫৭৪ মাদ্রাসা বানালো। সেখানকার ১ লক্ষাধিক মাদ্রাসাছাত্রের প্রতিদিন খাবারের জন্য এক কোটি টাকার খরচের যোগান দেন। সেখানেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর ওপর বারবার হামলা হচ্ছে, মার খাচ্ছে, জনগণের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, দু’শ বছরের পুরনো রেকর্ড নষ্ট হচ্ছে। মাদ্রাসা ছাত্ররা কি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে কালেক্টিভ পানিশমেন্ট দিচ্ছে?’

আইজিপি বলেন, ‘এদেশের মানুষ ধর্মভীরু-ধর্মপ্রাণ। সর্বধর্মের সমন্বয় শিক্ষা আমরা নবীর (সা.) কাছ থেকেই পেয়েছি। লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা-ভাংচুর করে তারা কোন দ্বীনের খেদমত করেন, এটাও ভাবতে হবে’।

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বছর বছর হামলা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে তারা কোন ক্ষোভ বা জিদ মেটাচ্ছেন, তাদের ক্ষোভ কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে?’

তিনি আরো বলেন, ‘ভয় পাবেন না। আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী একা নন, দেশের ১৮ কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে, দেশের আইন আপনাদের সঙ্গে আছে। ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এসব বরদাশত করা হবে না। দেশের কোনো অঞ্চলকেই উপদ্রুত অঞ্চল বানাতে দেওয়া হবে না’।

বেনজির আরো বলেন, ‘২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারির তাণ্ডবের বিচার হয়নি বলে এবার হবে না তা নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হামলা জঙ্গিবাদ থেকে কোনো অংশে কম নয়। জঙ্গিবাদ দমনে সাধারণ মানুষ যেভাবে সহায়তা করেছে, তাণ্ডবকারীদের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষই আমাদের সহায়তা করবে। যারা আমার টাকা খেয়ে আমার ঘর পোড়াবে-তাদের শনাক্ত করতে হবে’।

আইজিপি এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে বিকাল ৩টায় প্রেস ব্রিফিং করেন।

ব্রিফিংয়ে আইজিপি বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বারবার আক্রমণ হচ্ছে। আইনের শাসন থাকা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন আক্রমণ চলতে পারে না। প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার হওয়া উচিত। আমাদের কাছে সব ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তদন্তে ও শনাক্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩২ লাখ মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। প্রয়োজনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবব’।

তিনি আরো বলেন, ‘আগে হুজুররা রিকশায় চড়তে পারতেন না। এখন বড় হুজুরদের গাড়ি আছে। কেউ কেউ হেলিকপ্টার হুজুর নামের পরিচিত হচ্ছেন। এখন রাজনৈতিক আলেমের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু রুহানি আলেমের সংখ্যা বাড়ছে না। যারা মাদ্রাসার এতিম শিশু ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে তাণ্ডব চালায় তারা রাজনৈতিক শক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি নয়’।

তিনি আরো বলেন, ‘রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে কিন্তু রাজনীতির নামে জনগণের ধন-সম্পদ ধ্বংস করে কেনো? এসব বিদেশে ভিন্নভাবে প্রচারিত হয়। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে হিহ্নিত হতে দেব না’।

প্রেসব্রিফিংয়ের সময় আইজিপি ক্ষতিগ্রস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবকে পাঁচ লাখ ও সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের কর্তৃপক্ষের হাতে দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন।

আইজিপির সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের এসবি শাখার প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশ হেডকোয়ার্টার ডিআইজি (প্রশাসন) খুরশিদ হোসেন, রেলওয়ে ডিআইজি মো. শাহ আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত ডিআইজি ইকবাল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান ও পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান।