৩৯ বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন

৩৯ বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন

৩৯ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়। ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার দিন। বিশ^বিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে নানা আয়োজন করেছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছিল শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে বেলুন-ফেস্টুন উড়িয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম এবং বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন।

১৯৬০ সাল থেকে ৩৯ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করে আসছে।

নবম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তিনি সেই বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। তঁর সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজকের এই দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পাশাপাশি  বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদেরসহ সমগ্র বরিশালবাসী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও অগ্রগতি কামনা করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬০ সালে প্রথম বরিশালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। তখনকার সে দাবি তেমন কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালের এক জনসভায় বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।

যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সামনে এগোতে থাকে তখন ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তন। থমকে যয় সবকিছু। কিন্তু বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি থামেনি। বরিশালে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ২৩ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বরিশালের সার্কিট হাউসে এক কেবিনেট সভায় বরিশালে একটি পুর্নাঙ্গ বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণাও বাস্তবে রূপ নেয়নি।

এরপর ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে। সম্ভবত ১৯৮৯ সালে খুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ফুঁসে ওঠে। শুরু হয় আন্দোলন। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর চলতে থাকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠা নিয়ে শুধুই আশ্বাস। ১৯৯১ সালে প্রথম বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে তারা কোন উদ্যোগ নেয়নি।  পরবর্তীতে  আশ্বাস আর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে কেটে যায় আরও ২০ বছর।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বরিশ্লা ও পটুয়াখালিতে দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। বরিশালে স্বতন্ত্র বিশ^ব্যিালয় প্রতিষ্ঠা হবে এমন আশ্বাসে ২০০০ সালে পটুয়ালিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়। কিন্তু  বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়নি।

২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ২৮ হাজার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত করে সরকারি ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ করা হয়। এসময় ব্রজমোহন কলেজের স্বকীয়তা নষ্ট না করে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে বরিশালবাসী।

এক পর্যায়ে বিএনপি সরকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এবং ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বরিশাল নগরের অদূরে ডেফুলিয়ায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশ্য পরে সংসদে আইন পাশ করা হয় জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় নামে। শুরু হয় আরেক ষড়যন্ত্র। পরবর্তীতে আর ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। তত্তাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বরিশালে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পুনরায় বরিশালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। এসময়ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বরিশালে এককটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। তবে তা আলোর মুখ দেখেনি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম জিয়াউর রহমানের নামে করা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাতিল করে। একই সঙ্গে ৩০ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখ একনেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, ৩ মার্চ প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর একই বছর ২৮ অক্টোবর  শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বরিশালে এসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেন। ১৬ জুন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুমোদন করা হয়। 

শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ২২ ফেরুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশালের কর্ণকাঠী এলাকায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিক্ষ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। সেই থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

দীর্ঘ ৩৯ বছর প্রতিষ্ঠা হওয়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিস এ ৪ অনুষদের ৬ বিষয়ে ৪০০ শিক্ষার্থী নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু হয়। বাংলার ভেনিস খ্যাত বরিশাল নগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে কর্ণকাঠি এলাকায় ৫০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠা হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ৬টি অনুষদের ২৪টি বিভাগে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষর্থী অধ্যয়ন করছে।

বিশ^বিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে দুপুর ১২ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ¯œাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের নতুন শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০২০ উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মনে প্রাণে ধারণ করে তারা কখনো কোন অন্যায় ও দুনীতিকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।

সভায় অন্যান্যদের মধ্যে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দসহ বিশ^বিদ্যালয়ের ডিন, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, প্রভোস্ট, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, পরিচালক,ছাত্র উপদেষ্টা,  শিক্ষকমন্ডলী, শিক্ষার্থীবৃন্দ, দপ্তরপ্রধান, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।