‘পাপিয়ার চার কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়ায়’

চার কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়ায় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীর বিরুদ্ধে এ সপ্তাহেই (ঈদুল আজহার আগে) মামলা করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের ধারাও থাকবে এই মামলায়। ২০ জুলাই দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে পাপিয়া ও সুমনকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এখন তিনি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কাজ করছেন।
পাপিয়ার অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রবিবার শাহীন আরা মমতাজ বলেন, ‘অনুসন্ধানকাজ প্রায় শেষ। প্রতিবেদন লিখছি। ঈদের আগেই মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করার আশা করছি। কমিশনের অনুমোদন পেলে ঈদের আগেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’
কী কী সম্পদ পাওয়া গেছে তা জানতে চাইলে এই দুদক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাপিয়ার চার কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ওয়েস্টিন হোটেলের তিনটি কক্ষে তার বিপুল পরিমাণ ব্যবহৃত সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। যার মধ্যে রয়েছে ১০০ জোড়ার বেশি দামি ও বিদেশি ব্র্যান্ডের স্যান্ডেল এবং বেশ কিছু ঘড়ি।’
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে চলতি বছরের ১ মার্চ পাপিয়া ও সুমন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে মাদক ও জাল টাকার কারবারে সম্পৃক্ততা মিলেছে পাপিয়া ও সুমনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয় করা কোটি কোটি টাকার মুদ্রা পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। বহিষ্কৃত এই যুব মহিলা লীগ নেত্রী ও তার স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের নামে নরসিংদীর প্রাইম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ৮টি হিসাবের খোঁজ পায় দুদক। এসব ব্যাংক হিসাবেও বিপুল টাকা জমা এবং লেনদেন থাকলেও আয়ের বৈধ কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া অনুসন্ধানে পাপিয়ার যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে হোটেল ওয়েস্টিনে বিল হিসাবে জমা সাড়ে ৩ কোটি টাকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার করা নগদ ৬০ লাখ টাকা, নরসিংদী শহরে একটি বাড়ি ও ঢাকার ইন্দিরা রোডের ফ্ল্যাট ইত্যাদি।
দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা বলেন, ওয়েস্টিন হোটেলের যে তিনটি কক্ষ পাপিয়া ও তার সহযোগীরা ব্যবহার করতেন, অনুসন্ধানকালে সেগুলো পরিদর্শন করেছেন তিনি। ওই কক্ষগুলোর মালামালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ওই তিন কক্ষের মালামাল সরাতে গেলে বড় তিনটি ট্রাক লাগবে বলে ধারণা করছেন এই অনুসন্ধান কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে সেখানে ১০০ জোড়ার বেশি দামি স্যান্ডেল পাওয়া গেছে। যার বেশির ভাগই পাপিয়ার। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে দামি পোশাক, শাড়ি ও ঘড়ি পাওয়া গেছে। পাপিয়া নিজ হাতে স্বাক্ষর করে কত টাকা হোটেল বিল দিয়েছেন, সেই সব বিলের কপিও সংগ্রহ করা হয়েছে অনুসন্ধানকালে। পাপিয়ার গ্রামের বাড়িও পরিদর্শন করা হয়েছে।’
অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও জানান, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন ছাড়াও ওয়েস্টিন হোটেলের ওই তিনটি কক্ষে ৯ জন থাকতেন। কোনো আবাসিক হোটেলে থাকতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। পাপিয়া ও সুমনের ছাড়া অপর ৯ জন জাতীয় পরিচয়পত্রের যেসব ফটোকপি দিয়েছে তার সবই ছিল ভুয়া। অর্থাৎ পাপিয়ার সহযোগীরা ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে ওয়েস্টিনের মতো একটি অভিজাত হোটেলে থাকতেন।
দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা পাপিয়াকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে ১৩ জুলাই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেন। পরে আদালত জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিলে ২০ জুলাই তাদের কাশিমপুর মহিলা কারাগার ও কাশিমপুর কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আলোচিত ও বহিষ্কৃত এই যুবলীগ নেত্রীকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি র্যাব ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। একই সময় গ্রেপ্তার করা হয় পাপিয়ার স্বামী সুমন চৌধুরীসহ আরও ৫ জনকে। গ্রেপ্তারের আগে থেকেই একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নজরদারিতে রেখেছিল। গ্রেপ্তারের পর বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর থানায় তিন মামলা করে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর ঢাকা ও নরসিংদীতে পাপিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানায় র্যাব। পাপিয়া গুলশানের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেল ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালাতেন। অবৈধ কারবারে যে আয় করতেন, তা দিয়ে মাসে হোটেল ও মদের বিল দিতেন কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া তার জাল টাকা ও মাদকের কারবারের তথ্যও উদঘাটন করে র্যাব। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ এনে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে আলাদা মামলা করে সিআইডি। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে।
র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাপিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা আগের তিন মামলার দুটি তদন্ত করোনা মহামারীর কারণে থেমে আছে। ২৯ জুন অস্ত্র আইনের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১-এর উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আরিফুজ্জামান। মাদক মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে পাপিয়াকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এক দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর পাপিয়ার জ্বর, সর্দিসহ করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তাকে কাশিমপুর কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। যেকোনো সময় আবার তাকে র্যাব হেফাজতে নিয়ে বাকি ১৩ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে।
সিআইডির করা অর্থ পাচার মামলার অগ্রগতি বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম টিমের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘মামলার তদন্তকাজ কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। কিছু ব্যক্তির নাম থাকায় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। শিগগিরিই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী পাপিয়াকে রাখা হয়েছে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে।