‘রিজার্ভের যে অবস্থা, জ্বালানি কেনার পয়সা নেই’ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মন্তব্য

‘রিজার্ভের যে অবস্থা, জ্বালানি কেনার পয়সা নেই’ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মন্তব্য

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন শিল্প-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) ব্যবসায়ীরা। 

‘রিজার্ভের যে অবস্থা, জ্বালানি কেনার পয়সা নেই’ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মন্তব্যে ব্যবাসায়ীরা হট্টগোল শুরু করেন।  এক ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা সব কর্মীদের নিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। আপনি নারায়ণগঞ্জে যান, সেখানে একটি ফ্যাক্টরি ছাড়া আর কোনো ফ্যাক্টরি চলছে না।

রবিবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত শিল্পে জ্বালানি সংকট সমাধান শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তৌফিক-ই-ইলাহী প্রধান অতিথির বক্তব্য দেওয়ার সময় এ বাহাস হয়। ব্যবসায়ীরা হট্টগোল শুরু করলে কিছুক্ষণ বক্তব্য থামিয়ে দেন জ্বালানি উপদেষ্টা। 

ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা দেন। এ সময় টিপ্পনি কেটে উপদেষ্টা বলেন, এই হলরুমে এখন এসি চলছে। এখানে তো এসি থামালেন না। এখানে তাপমাত্রা কত জানতে চান তিনি। দিনের বেলায় সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার শপথ নিতে বলেন তৌফিক-ই-ইলাহী।

এ সময় তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কী হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।

এর আগে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন, নাইট শিপ্টে কারখানা চালু রাখতে পারছি না। এ ব্যাপারে সমাধানের জন্য জ্বালানি উপদেষ্টাকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমার ফোন ধরেননি।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, দেড় মাস ধরে আমার ফ্যাক্টরিগুলো নাইট শিফটে কাজ করতে পারছে না। নাইট শিফটে কাজ করা কর্মীরা চাকরি হারানোর পথে। জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে আমি পরামর্শ চাইব, আমাকে সাজেশন দেন তাদের এসব যন্ত্রণা থেকে কীভাবে অব্যাহতি দেব। আমাদের রেভিনিউ ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল, এখন এমন অবস্থা এক বছর পর আমাদের বেকারত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কবে শেষ হবে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেলে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিতাম। আমাদের ভোলায় কিছু গ্যাস আছে, সেগুলো সিএনজিতে করে নিয়ে আসব। সেখানে ৮০ এমএমসি গ্যাস আছে। আমরা দু-তিন মাসে সেটা নিয়ে আসার চেষ্টা করব। অপরদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পাব। আরও এক হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করব। তখন অনেকটা সমস্যার সমাধান করতে পারব।

তিনি বলেন, আজ যদি আমরা গ্যাস বাঁচাতে চাই তাহলে লোডশেডিং বাড়বে, তখন আপনারাই সমালোচনা করবেন। অথচ একসময় সব জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা চাইলে এসি বন্ধ রাখতে পারি, বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে পারি। সারাদেশে যে পরিমাণ এসি চলে, তাতেই ৫ থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা আছে। আমরা এসি বন্ধ রাখব বা কম চালাব, এতে দু-তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। গ্যাস সাশ্রয় হবে। সবাই মিলে যদি রাজি হই লোড কমাব তাহলে কিছু গ্যাস রিলিজ হবে।

আমরা কৃষি ও ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুৎ বেশি দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে অন্যরা বিদ্যুৎ ব্যবহার কম করব। প্রয়োজনে দিনের বেলা ব্যবহারই করব না। বিদ্যুৎ যদি আমরা শিল্পে দিই, তাহলে আবাসিকে সাপ্লাই কমাতে হবে। সেটা করলেই আবার মিডিয়ায় অনেকেই অনেক কথা বলবেন।

তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, যুদ্ধের সময় তো আমাদের কিছুই ছিল না। তখনও আমরা চলেছি। এখনও পারব। আমরা শপথ নেব, দরকার হলে দিনের বেলা কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহার করব না।

সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী যখন শিল্প-কারখানা খুলে দিলেন, তখন অনেক বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করেছিলেন। তখন শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। চলমান এই জ্বালানি সংকটে প্রধানমন্ত্রীকে এখন সেই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি আরো বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি এনার্জি রেশনিং করেন। কিছুদিন আগে ব্যবসায়ীদের আবদারে তেলের দাম বাড়ানো হলো, তাতে মূলত কোনো লাভ হয় নাই। এ ছাড়া বিবিএস কোনো তথ্য দিতে পারে না। তারা ২০১৩ সালের ইন্ড্রাস্ট্রি শুমারি দিয়ে এখনও চালাচ্ছে। এটা ঠিক না।

তিনি বলেন, আজকে শিল্পগুলো ডোবার ব্যবস্থা হয়েছে। আরও ডুববে, ব্যাংকও ডুববে। এখন দ্রুত বিদ্যুৎ গ্যাস সরবরাহ করেন, আমরা বেঁচে যাই। গ্যাসের ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইনকে ডোমেস্টিক লাইন থেকে আলাদা করে দিন। তেলে ভ্যাট কমিয়ে দিন। তেল আমদানিতে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ ভ্যাট নেয়ার কী দরকার।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আমাদের টেক্সটাইল খাত বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমরা ভালো নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ ফান্ডের টাকা ফেরত দিতে পারব না। গভর্নর আমাদের হাত-পা বেঁধে পানিতে ছেড়ে দিয়ে বলছেন, এবার সাতার কাটো। এখন আমাদের দাবি, ইডিএফ ফান্ড ফেরত দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে হলে, এক লাখ ডলারের গ্যাস দিলে ২৪ লাখ ডলারের রপ্তানিমূল্য এনে দিতে পারব। আপনারাও বাঁচেন, আমাদেরও বাঁচান।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিসিআই সভাপতি আনোয়ারুল পারভেজ বলেন, দেশ এখন আর্থিক সংকটের মধ্যে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ সব সংকট একীভূত হয়েছে। দেশের ৪২ শতাংশ পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে আবার ৩ শতাংশের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই শোচনীয়।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন প্রমুখ, ফিকির সিইও স্বপ্না ভৈৗমিক, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।