‘সবার উপরে মানুষ সত্য’

দীলিপ কর্মকার:
ওরে মূর্খ, ওরে ধর্মান্ধ, ওরে ধর্ম-মাতাল,
ওরে উগ্র, ওরে খুনী, ওরে ফারাবী,
ধর্মের নামে করবি কতকাল খুন-খারাবী?
ধর্মের নামে করবি কত অধর্ম, কু-ধর্ম, ভন্ডামী?
ওরে খুনি, আমার দেহকে তুমি হত্যা করতে পার, কিন্তু আমাকে না, আমার পরম আমি'কে না। আমার চিন্তা-চেতনাকেও না। আমার মতামতকেও না।
আমি মরলে, আমার নিথর মর দেহটাকে দেখে সবাই বলবে, এটা অমুক ভাই/দাদা/কাকা/জ্যাঠার লাশ। কারণ ওটা আমি নই, ওটা আমার মরা লাশ! তাহলে বল, আমি কে?
কে স্রষ্টা? কে সৃষ্টি?
সৃষ্টি'র আলাদা, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ক্ষণিকের তরে,
সাময়িক ইচ্ছাশক্তি ও নির্বাচনী ক্ষমতার অধিকারী, আপাততঃ এ-অস্তিত্ব কোথা হতে এসেছে, কোথায় হবে বিলিন?
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি আলাদা তো কিছু নয়; সৃষ্টিরূপে স্রষ্টার অখণ্ড, একক অস্তিত্বের প্রকাশ, বিকাশ।
স্রষ্টাই সর্বত্র, স্বর্বভূতেষু!
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি আলাদা অর্থাৎ দ্বৈতসত্তা ভাবাই- দ্বৈতভাব, দ্বৈতবাদ বা অংশীবাদ!
জগতে এ-ধারনাই সংখ্যাধিক্য-
‘আমি একটি সৃষ্টি আমার একজন স্রষ্টা আছে।’
প্রকৃতপক্ষে, ‘জগতে সৃষ্টি বলতে কিছু নেই, সবকিছুই এক দেহের অন্তর্গত, সকল অস্তিত্বশীল সত্ত্বার মূল সত্ত্বা এক। সকলই মূলত এক এবং সকল কিছুই এক ঐশী পদার্থের বিভিন্ন রূপ মাত্র। ক্ষুদ্র-বৃহৎ অথবা অনু সদৃশ যা'কিছু আছে সবই অখণ্ড এককরূপ।’
'ধর্ম সে-তো সহনশীল বর্ম';
পরমত সহিষ্ণুতা আর ধৈর্য্য!
সমাজে ধর্ম বলতেই আমরা সাধারনতঃ বুঝে থাকি প্রথাগত স্থূল, আনুষ্ঠানিক সর্বস্ব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিকে, যথাঃ সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম প্রভৃতি। যাকে আমরা কেবল বিশ্বাসের বিষয়বস্তু রূপে গণ্য করে থাকি। এবং ধর্মকে আমরা শুধুমাত্র এসব নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে থাকি। এর বাইরেও যে, ধর্মের সংজ্ঞা হতে পারে বা থাকতে পারে তা আমরা অনেকে চিন্তা-ভাবনা করে দেখি না। এ ব্যাপারে অনেকে বেশ উদাসীন, অনেকে আবার উন্নাসিকতা প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে ঐগুলি ধর্ম নয়। ঐগুলি মত বা পথ আর এজন্য বলা হয় সনাতন ধর্মমতাবলম্বী, খ্রিষ্টান ধর্মমতাবলম্বী প্রভৃতি।
ড. মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত লোকের ধর্ম’। ‘Religion is the culture of common folks and culture is the religion of educated, elegant people.’
ধর্ম অর্থ ধারণ করা; অথবা ধারণকৃত স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, ব্যবহার, গতিপ্রকৃতি। মানুষ যা ধারণ করে তা তার ধর্ম বা কর্ম। এক কথায় মনমস্তিষ্কে যা উদয় হয়, তা-ই বিলয় হয়! এ উদয়বিলয়ের পথে মানুষের ধারণকৃতদ্বার বা সপ্তইন্দ্রিয়দ্বার সমূহ হলঃ চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, কন্ঠ (কথা), ত্বক ও মন। এগুলো দিয়ে মানুষ যথাক্রমে দৃশ্য, গন্ধ, শব্দ, স্বাদ, ভাব, স্পর্শ এবং অনুভূতির কর্ম সম্পাদন করে থাকে। মোট কথা কর্মই ধর্ম। ধর্ম বা কর্মকে সুন্দর সুচারুরূপে দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করার জন্য যুগে যুগে আগত ধর্মবিজ্ঞানী সময়োপযোগী কিছু বিধান বা পদ্ধতি দান করেন যা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সদা পরিবর্তনশীল। সুতরাং ধর্মের আরেকটি অর্থ বিধান। কাজেই আমাদের ধারণা ধর্ম শব্দের সাথে বিশ্বাস বা বিশ্বাসী শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ না। বিশ্বাস একটি ভঙ্গুর, পরনির্ভরশীল শব্দ। যেখানে অবিশ্বাস বা সন্দেহের অবকাশ থাকে, থাকে প্রমাণের, যুক্তিতর্কের.....
আমাদের ধারণা-‘মানুষের স্বভাবধর্ম, আত্মধর্ম কি? আত্মধর্ম- নাস্তিক না আস্তিক সে যাই হোক না কেন সে-টা তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার বা ব্যক্তিগত বিষয়; কিন্তু তাঁর ‘আত্মধর্মের আস্তিকতা বা নাস্তিকতার দ্বারা যদি অন্যের কোন ক্ষতি সাধন হয় তাহলেই সমস্যা! যে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা ‘মানবতার’ অবমাননা- অবদমিত- লঙ্ঘিত হয় সেটা মানব সমাজের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে তা না থাকাই শ্রেয়। ‘মানুষ’ এর মান রক্ষার জন্য কতটা মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে হয়? মানবতার শক্তিশালী মানদণ্ড দাঁড় করাতে কি পরিমাণ সম্যক সঠিক, মানবিক হতে হয়? সে-সবের জবাব হল ‘মানুষ’ এর চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’;
যে ধর্ম মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে সেটা ধর্ম হয় কি-করে? সে-টা তো অধর্ম/কুধর্ম। সে-টা মানুষের জন্য নয়। ওহে মানুষে-মানুষে বিভেদকারী বকধার্মিক! শোন মানুষের জন্য এসেছে ধর্ম, ধর্মের জন্য আসেনি মানুষ কোনো।
মানুষের চেয়ে ধর্ম বড় হলে, সে-টা হয় অধর্ম/কুধর্ম। ওহে কুধার্মিক! শোন, মানুষের জন্য এসেছে আল্লাহ-খোদা-ঈশ্বর-ভগবান, আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, ভগবানের জন্য আসেনি মানুষ কোনা। আসুন, অন্ততপক্ষে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে মানুষকে ভালবাসি, আপন করে কাছে টানি। এবং
গাহি সাম্যের গান
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই।’
শোন,
যারা মানুষের কল্যাণে আসেনা তারা অমানুষ শয়তান। তাদের দিয়ে আল্লাহ, খোদা, ভগবান, ঈশ্বরের হয় অকল্যাণ।
হোক মানুষের তরে মানুষের বিজয়।
পরিশেষেঃ মানবতার কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, বিদ্রোহী কবি, স্বভাব কবি-দ্বয়ে'র অমৃতসুধা দিয়ে শেষ করছি-
‘এমন মানব সমাজ কবেগো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে’ --- লালন।
‘হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমা হারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কন্ঠে সেই সৃষ্টিতে আদিমবাণী ফুটাও দেখি। বল দেখি, ‘আমার মানুষ ধর্ম’। মানবতার এই মহান যুগে একবার গন্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও, তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’ ---নজরুল।
সূত্রঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর প্রবন্ধ, কবিতা সমগ্র