আহা কি সুন্দর এই নাম

আহা কি সুন্দর, কি সত্য, কি নির্দিষ্ট এই নাম কাজী আলাউদ্দিন। না জানি না, এই মানুটির বাবার নাম। জানি না এই সন্তান হারা মা বেঁচে আছেন কি না। জানা হয় নাই তার বাড়ির নির্দিষ্টতা, পরিবারে আর কে কে আছে? প্রচন্ড উজান ঠেলে সামনে যাওয়া এক নাম আলাউদ্দিন। মৃত্যুকে অর্থহীন করে দেশের অর্থকে, স্বাধীনতার অর্থকে, নির্মাণ করে গেছেন নিজের রক্ত ও প্রাণ দিয়ে, তার নাম আলাউদ্দিন। ঊণসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে অকুতভয় রাজপথের লড়াকু রাজনৈতিক শহীদ আলাউদ্দিন। এ যেন এক প্রচন্ড বৈরীতা অতিক্রমকরীর নাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সে আবার এসেছে এই শহরে। এসে দাঁড়িয়েছে সেই স্থানে। যেখানে তাকে গুলি করে হত্যা করেছিলো ইপিআর। হ্যাঁ, আমি শহীদ আলাউদ্দিনের কথাই বলছি। বড় কম জানি তাঁর সম্বন্ধে। এ লজ্জা আমাদের। দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে তার জন্মস্থানে নির্মিত সেতুর নাম হবে শহীদ আলাউদ্দিন সেতু। তার জন্য মানববন্ধন করতে হবে? তবু হয়েছে, যারা পেরেছেন এমন সত্য, সৎ, সঠিক, যোগ্যতম কর্মটি করতে তাদের সবাইকে নতজানু সালাম। একই সঙ্গে লজ্জিত, খবরটি জানতে ব্যার্থ তার জন্য। এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারার জন্য।
আমাদের হয়তো স্মরণে আছে নিকট অতীতে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী দেশের সর্ব বৃহত সোলার প্যনেলের নাম, তার নামে প্রস্তাব হওয়াকে বাতিল করেছেন। তাঁর এই যোগ্যতর সিদ্ধান্তের জন্য সাধুবাদ উচ্চারিত হয়নি কোথাও! এটিও একটি লজ্জাস্কর অনুশীলন আমাদের। ভালোকে ভালোরূপে স্বীকৃতি না দেওয়ার।
বোধহয় দেশ জাতি একটা সময় ভালো মন্দের পর্থক্যটা বুঝতে ব্যর্থ হয়। হয়তো আমরা এখন সেই সময়টাই অতিক্রম করছি। তা না হলে এই শহরে মহাত্মা অশি^নী কুমারের নিজ বাড়িতে অবস্থিত সরকারি কলেজের নাম তার নামে হবে, এমন উদ্যোগেরও বিরোধীতা হয়েছে প্রকাশ্যে। সকল বোধবুদ্ধি এবং স্বাভাবিকত্বের বাইরে এই বিরোধীতা করেছেন সাংস্কৃতিক সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা নেতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক মানুষ। অদ্ভুতভাবে এই বিরোধীতায় সম্পৃক্ত ছিলেন বরিশাল মহাশশ্মান কমিটির নেতা, সরকারি ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক পরিষদের নেতাও! অশি^নী কুমারের বিরোধীতায় এত এত মানুষ দেখা গেল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাঁর পক্ষে এগিয়ে আসেনি কোন কলম। যাদেরকে লেখক না বললে তারা এমন ভান করেন যেন রবীন্দ্রনাথ ওদের রাড়িতে থেকে লেখাপড়া শিখেছেন! একজন সরকারি চাকুরিজীবী যিনি অশি^ণীকুমারকে প্রায় পিতা জ্ঞান করেন। তাকে বলেছিলাম সেই আন্দলনের সময় ‘কেন লেখনা কিছু’? পরিষ্কার উত্তর ছিলো অবসরের আগে কোন মহাত্মার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ নাই!
অথচ সেই মহাত্মা নির্মিত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনটির নাম বরিশালের অন্যতম রাজনীতিক সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৭৫-এর শহীদ জননী শ্রদ্ধেয় সাহান আরা বেগমের নামে করা হলো। এই তো নিয়ম। এমনটা তো হতেই পারে। হচ্ছে তো। এভাবেই হয়তো একদিন সত্য প্রেম পবিত্রতার এই পবিত্র ভুমিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় জয়ন্ত কুমার স্যারের নামেও কোন ভবনের নামকরণ হবে! হয়তো সে হবে কাল, নয়তো আরো পঞ্চাশ বছর পরে। এমন করেই মহানদের নাম, শ্রেষ্ঠদের নাম যুগ যুগ থেকে যায় ও যাবে। তবে কেন উত্তাল ঊণসত্তরে বরিশালের প্রথম শহীদ, আলাউদ্দিনের নামে লেবুখালি সেতু নয়? তার নাম তো বাংলাদেশের ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়।
ঠিক জানি না। মাঝে মাঝে তাই খুব জানতে ইচ্ছা হয়। কেন সাংস্কৃতিক চর্চায় সম্পৃক্ত হয়েছিলাম? হয়তো বুঝেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম এরা সত্য বলে সত্যের পাশে দাঁড়ায়। কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠকদের অপরিনামদর্শি কর্মউদ্যোগের ফলে, সেই ধারণা যেন আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রায়সই এখন মনে হয়, আমরা সবথেকে বেশি মিথ্যার পাশে থাকি, আর সত্য নাই বলে এক অসত্য আক্ষেপ উচ্চারণ করি।
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, আবৃত্তিশিল্পী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।