করোনা ও ওমিক্রণের আশ্রয় কেন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

করোনার ভয়াবহতায় শিক্ষার্থীরা যাতে আক্রান্ত না হয় সেই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে গত প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। দীর্ঘ এই সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ সময় খোলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, বিনোদন, জনসভা সবকিছু। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে অনেক কন্যা সন্তান। শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক না থাকার কারণে শিশু থেকে শুরু করে যুবকরা নেতিবাচক কাজের সঙ্গে সমৃক্ত হয়ে পড়েছে। পরিবার এবং সমাজের দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। অনলাইনে পাঠদান চেষ্টা তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। বাধ্য হয়ে অটোপাস ও শ্রেণি উত্তোরণের অহেতুক বোঝা নিয়ে শিক্ষার্থীরা কেবল দিন অতিক্রম করেছে। এক পর্যায়ে বিশ^বিদ্যালয়সমূহে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে যখন শিক্ষার্থীরা কেবল হাফ ছেড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখি হতে শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় হতাশ হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। কোথায় যাবে দেশের বৃহত্তর এই সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীরা।
গত প্রায় দেড় বছর করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এবার অমিক্রণের প্রভাব বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, ঠিক তখন কিছু শর্ত দিয়ে অন্য সব দপ্তর প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব বিষয় দেখে মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে করোনা এবং ওমিক্রণের আশ্রয় কেন্দ্র কি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? এই ভাইরাস কি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী উপস্থিত হলেই আক্রমণ করবে? সেই ভুতের গল্পের মতো হালুম হালুম হালুম, মানুষের গন্ধ পেলুম। এখন মনে হচ্ছে করোনা ও ওমিক্রণ ভয় দেখাচ্ছে, ‘হালুম হালুম হালুম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে তোদের ঘার মটকে খালুম’। তাই, খবরদার তোরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবি না। খাবি আর ঘুরে বেড়াবি, তাতে কোন সমস্যা নেই।
স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, ‘করোনা এবং ওমিক্রণ’রা বলছে, আমরা হাট, বাজার, অফিস-আদালত, কলে-কারখানায়, বিয়ে বাড়ি, জনসভা, বিনোদন কেন্দ্রে থাকতে পারছি না। হাট-বাজার, জনসভা, বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে আমাদের চেয়েও ভয়াবহ মানব জীবানু থাকে। তাই আমরা ওসব জায়গায় তেমন সুবিধা করতে পারি না। আমাদের একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করতে খুব সুবিধা। তাই শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হলে, তোমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দাও। তা না হলে আমরা ওদের ঘারে চেপে বসবো। তাই করোনা ও ওমিক্রণের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ঘোষণা হলো। যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও শিক্ষার্থীদের কাছে এটা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছে, দেশের সবকিছু খোলা রেখে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী ১০০ জন পর্যন্ত সমাবেশ করা যাবে। যদি ১০০ জনের সমাবেশ করা যায়, তাহলে ৬০-১০০ জন শিক্ষার্থীর শ্রেণিক্লাশ কেন বন্ধ রাখতে হবে? করোনা ও ওমিক্রণ ঝুঁকি মোকাবেলার সকল ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিন। যেভাবে অফিস আদালন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যেতে পরে।
২০২০ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার যথাযথ কারণ ছিল। কারণ তখন করোনা ভারাস সম্পর্কে ধারণাই ছিল না। তার ভয়বহতা এবং মৃত্যুর মিছিল আমাদের বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তাই সরকারি সিদ্ধান্তে আশ^স্তও হয়েছে বেশিরভাগ মানুষ। যদিও সেসময়েও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত ছিল। এরপর আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সরকার করোনাকে জয় করার পথে এগিয়েছে। সারা বিশে^র চেয়ে বাংলাদেশ অনেকটা নিরাপদ অবস্থানে আছে। এছাড়াও সারা দেশে দুই ডোজ টিকা পেয়েছে অনেক মানুষ। এমনকি বুস্টার ডোজও দেওয়া শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও টিকার আওতায় এসেছে। সেই সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলেছে।
অটো প্রমোশন ও অটো পাশের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ২০২১ সাল পার করেছে শিক্ষার্থীরা। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে। বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে কেবল পাঠদান শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই ওমিক্রণের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে সরকার আবারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নতুন বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে। এই অবস্থা থেকে শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের আশ^স্ত করা একান্ত জরুরী। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন নিশ্চিতে কার্যকর ও বাস্তবমুখি উদ্যোগ নিতেই হবে।
বাস্তবে বাংলাদেশ এখনো অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সারা দেশে শিক্ষার্থীদের যেমন অনলাইনে পাঠ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারেনি। সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর প্রতিই জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে, করোনা টিকা দেওয়া নিশ্চিত করে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেবে। সেই ভবিষ্যত কারিগরদের শিক্ষা জীবনের নিশ^য়তা দিতে ব্যর্থ হলে তার দায় আমাদেরই নিতে হবে। তাই যেসব নিয়ম মেনে সারা দেশ পরিচালিত হবে, সেইসব নিয়ম মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।