দুর্গোৎসবে জনসচেতনতা: মঠবাড়িয়ার রাজ মন্দিরে ব্যতিক্রমী পূজার আয়োজন

দুর্গোৎসবে জনসচেতনতা: মঠবাড়িয়ার রাজ মন্দিরে ব্যতিক্রমী পূজার আয়োজন

প্রকৃতিতে কাশফুলের শুভ্র আলিঙ্গন। সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে চারদিকে। জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে শরত আসছে। আসছে দুর্গতি নাশিনী দেবি দুর্গা। মা ধরায় আসছে নিয়ম মেনেই। অশুভ শক্তি বিনাশ করে প্রকৃতিতে শান্তির পরশ দিয়ে আবার ফিরে যাবেন মা, এমনই প্রত্যাশা সনাতন ধর্মের ভক্তদের। তাই দূর্গা পুজা আজ ধর্মীয় গন্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রমী নানা আয়োজনে দুর্গোৎসব সমাজ সচেতনতা এবং মানবতার জয়গানে মেতেছে। 

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

দুর্গা পূজা আয়োজনের মাধ্যমে ধর্মীয় পৌরানিক ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সমাজের বিভিন্ন ইতিবাচক দিক তুলে ধরে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন চিকিৎসক সুদীপ হালদার। ৩৩৩টি দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে এবছর দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি দুর্গোৎসবের মাধ্যমে মানবতার আহ্বান জানিয়েছেন। বরিশাল বিভাগের ব্যতিক্রমী এই আয়োজন বসেছে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার গুলিসাখালী ইউনিয়নের কবুতরখালী গ্রামের রাজ মন্দিরে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের নিমন্ত্রণপত্র দেখে আগ্রহী হয় ভোরের আলো। এই আয়োজন করে সাড়া ফেলেছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুদীপ কুমার হালদার ও গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্নিগ্ধা চক্রবর্তী। বছর জুড়েই এই দম্পতি দুর্গা পূজা নিয়ে ভাবেন। আয়োজনের বাড়ির বিষয়গুলো দেখেস সুদীপ হালাদারের বাবা, প্রধান শিক্ষক শৈলেশ্বর হালদার। আর বাইরের সববিষয় দেখভাল করেন সুদীপ হালদার। ভোরের আলোর পক্ষ থেকে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন দেখতে সুদীপ হালদারের বাড়িতে যায়।

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

বাড়ির প্রবেশ পথে লেখা রয়েছে রাজ মন্দির। রাজ মন্দির-ই বটে। শারদীয় দুর্গা উৎসবের আয়োজন দেখে তাই-ই মনে হচ্ছে। দুর্গা পূজার মাধ্যমে মানবতার আহ্বান জানানো, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক মিলনমেলার আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাজ মন্দিরের স্বত্তধিকারী ও তার পরিবার।

এবার দুর্গা পূজার প্রতিপাদ্য করা হয়েছে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও নারীর মর্যাদা দেওয়া। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-ই পুজার মূল প্রতিপাদ্য। নারী সমাজকে প্রধান্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিমাগুলো। পূজার মাধ্যমে সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে চলেছেন মৃৎশিল্পীরা। দুর্গোৎসবে থাকছে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের কাহিনী, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, কৃষকরাই বাংলাদেশ বিনির্মানে কাজ করছে তাই রাখা হয়েছে কৃষি কাজ ও কৃষক কর্ণার, মাতৃদুগ্ধপানের কর্ণার, স্বাস্থ্য কর্ণার, ধূপ কর্ণারসহ নানা নায়োজন। দুর্গা পুজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আকাঙ্খা তার।

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

সরেজমিনে চিকিৎসক সুদীপ হালদারের বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে রাজমন্দির। রাজ মন্দিরই বটে। এই রাজ মন্দিরের বিশাল আঙিনা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গোৎসবের প্যান্ডেল। তাতে সারিবদ্ধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিমা। ১৮জন মৃৎশিল্পী চার মাস ধরে নির্মাণ করে চলেছেন সনাতন ধর্মের ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রতিমাগুলো। ৩৩৩টি দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মার্ণের মাধ্যমে এই মন্দিরে চারহাজার বছরের পুরানো পৌরাণিক কাহিনীকে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সঠিক পথে আগ্রসরের তাগিদ দিতে গ্রাম জুড়ে গাছের সঙ্গে সাটানো হয়েছে পবিত্র কোরআন ও মহানবী (সঃ) বাণী, পবিত্র গীতা ও বাইবেলের বিভিন্ন উপদেশ মূলক মন্তব্য।

মন্দিরের আঙিনায় হাঁটতে হাটতে আয়োজন নিয়ে কথা চলে সুদীপ হালদারের সঙ্গে। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুদীপ কুমার হালদার ও গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্নিগ্ধা চক্রবর্তী দম্পত্তির ব্যক্তিগত এই বৃহৎ দূর্গোৎসবের আয়োজন বিভাগ জুড়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। উৎসহ-উদ্দিপনা দেখা গেছে স্থানীয়সহ বিভাগের  সব ধর্মের মানুষের মাঝে। প্রতি বছরের মতো এই উৎসবকে ঘিরে তাদের কবুতরখালীর হালদার বাড়িটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে।


পূজার সার্বিক দিক নিয়ে ডা. সুদীপ হালদার ভোরের আলোকে জানান, গত বছরের চেয়ে এ বছর তিনগুণ পুজারী ও দর্শনার্থীর সমাগম হবে। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের মিলনমেলা বসবে এবারের দুর্গোৎসবে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। তিন বছর আগে প্রথম ৪০টি প্রতিমা নিয়ে এই মন্দিরে পূজার আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই দুর্গা পূজাকে সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র এবং সমাজের ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরার আকাঙ্খা ছিল। সেই আকাঙ্খা থেকে দ্বিতীয় বছর ১৫৭টি প্রতিমা ও ২৫টি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এ বছর ৩৩৩টি প্রতিমা ও অর্ধশত মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রতিমাগুলো সনাতন ধর্মের ইতিহাস। এর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার ইচ্ছা রয়েছে। সামাজিক সেতুবন্ধ রচনায় কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ তুলে ধরা হচ্ছে পূজার মাধ্যমে। আগামী ৩ অক্টোবর মহাপঞ্চমীর মধ্য দিয়ে পূজার কার্যক্রম শুর হবে।

চিকিৎসক স্নিগ্ধা চক্রবর্তী বলেন, দুর্গা পূজা উপলক্ষে ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুরে চলে গণভোজ। এই ভোজে অংশ নেয় শতশত মানুষ। পূজা উপলক্ষে ভোজ করিয়ে তিনি ও পরিবারের সদস্যরা আনন্দ পান। তিনি আরো বলেন, এবারের পুজা রাজ মন্দিরের মূল থিম, ‘নারী নির্যাতন বন্ধ করুন’, ‘যৌন হয়ারনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান’, ‘মাদক থেকে দূরে থাকুন’। ইতো মধ্যে এই সকল শ্লোগান মন্ডপ জুড়ে সাটানো হয়েছে। সাথে যারা স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন তাদের পোশাকে এমন শ্লোগান উল্লেখ্য থাকবে।

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

 

মঠবাড়িয়ার কবুতরখালীর রাজ মন্দিরের বিশাল প্যান্ডেল জুড়ে দেবী দূর্গাসহ ৩৩৩টি বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। চলছে শেষ মুহূর্তে রঙ-তুলির কাজ। কয়েকটি সারিতে মূল প্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে প্রতিমা। প্রতীমার কারিগরগণ তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়া আর রং-তুলিতে অপরূপ সাজে সাজাচ্ছেন প্রতিমাগুলো। নান্দনিক সাজের পাশাপাশি পৌরানিক কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে গহনা পরানো হয়েছে।

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-

 

খুলনা চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃৎশিল্পে প্রশিক্ষণ পাওয়া সাতক্ষীরা জেলার প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী শংকর মন্ডল বলেন, গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে প্রতিমা নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। এত বড় আয়োজন আমার জানা মতে বাংলাদেশে আর কোথাও হচ্ছে না। বড় একটি আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পারার আনন্দ বলে বোঝানো সম্ভব নয়। প্রতিমা নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখন চলছে রঙ-তুলির কাজ। পূজোর দুইদিন আগেই সাজ-সজ্জা শেষ হবে। এমন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে চান এই মৃৎশিল্পী শংকর মন্ডল।

ব্যতিক্রমী দুর্গোৎসবের আয়োজক ডা. সুদীপ হালদার তাঁর বাড়ির এই আয়োজন দেখতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

 ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-




এসএইচঅ/ ভোরের আলো/ ২০.০৯.১৯