দেশ সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িকতা এবং মহাত্মা অশ্বিনী কুমার

দেশ সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িকতা এবং মহাত্মা অশ্বিনী কুমার

খুব সকালে কোন ফোন এলে মনটা খুব অস্থির এবং বিচলিত হয়ে ওঠে। তেমনি এক ফোন আজ সকালটায় মনের গভীরে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে আমায় স্তম্ভিত করে দিল। মনে হলো খুব হিসেব করে ফোনটা আমার কাছে এলো। না করলেও পারতো। তবু করলো। এবং  বোঝালো, ‘এবার দারুন এক পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেলে তোমরা। কিচ্ছু করার নেই রে। বিষয়টা মাথায় নিয়ে, বুঝে, মেনে নিয়ে এবার থেমে যা। যে কারণে উদীচী চারুকলা মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এতো বিভেদের পরেও একাত্ম হলো। সেটা আর হলো না। মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নাম এই মুহূর্তে বরিশাল কলেজের সঙ্গে আর সম্পৃক্ত করার সম্ভবনা নাই। কি? চুপ কেন? চ্যানেল ২৪ ঘন্টা দেখো। অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের জায়গায় বিশাল রাম মন্দিরের শিলান্যাস করছেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।’

অতঃপর সত্যিই টেলিভিশনটা খুলে খবর দেখলাম। অনেকটা সময় ধরে ভালো বুঝতে পারছিলাম না- এটা কি হলো। কি করলো ওরা? না, এমন একটি খবরের দৃশ্য দেখবার পরে নিজের মনটাকে যে খুব ভালো বুঝ দিতে পেরেছি তেমনটা বলবার মত সৎসাহস আমার নেই। সেটা বলা ভন্ডামি হবে। কারণ আমিও তো মানুষ। আমারও তো দেশ আছে, আমারও তো আছে ধর্ম, আছে সম্প্রদায় এবং আমিও তো স্বাধীন। তা হলে কেন এভাবে ধর্মীয় উগ্রতার কাছে রাষ্ট্রের এমন নতী শিকার? আসলে এটাই এই উপমহাদেশের রাজনীতির এক চরম স্খলিত রূপ। আমাদের অপরিনামদর্শী নিয়তি। এক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি অতি জঘন্য কুট কৌশলে অন্য সম্প্রদায় দ্বারা পদদলিত। যা ভালো বুঝতে পারি না বলেই নিজের মধ্যে থেকে এক সহজাত প্রশ্ন- সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টা আসলে কি? কিভাবে এর উৎপত্তি এবং প্রয়োগ? এর ব্যবহারবিধিই বা কি, কে তার নিয়ন্ত্রক?

না, আমি শুধু জানবার জন্য এই প্রশ্নগুলো করছি। আমি বা আমরা যতদূর বুঝতে পারি, নিঃসন্দেহে আমরা সবাই তার থেকে অনেক বেশি বলি। আপত্তি নেই। এমনটা হতেই পারে। আকসার এমনটাই হচ্ছে প্রায় সর্বত্র সকল বিষয়ে। মূলত আমাদের অতি সহজ সম্প্রদায় জ্ঞান, বিষয়টি বলা যায় প্রায় নির্ধারিত। খুব সাধাসিধা ভাষায় বললে বলতে হয় সেটা ধর্মীয় সম্প্রদায়। তবে এই সম্প্রদায় বিষয়ক বিবরণী সবগুলো বলা প্রায় অসম্ভব। তবে কেউ কেউ নিশ্চয়ই পারেন না এবং জানেন না বিষয়টা তেমন নয়। নিশ্চয়ই জানেন। সেই সকল মানুষদের জিজ্ঞেস করলে আমাদের যে অতি সহজ সরল সম্প্রদায় জ্ঞান, সেই জ্ঞানে প্যাচ লেগে যাওয়ার সম্ভবনাই প্রবল।

তাদের চিন্তায় সাপুরেরাও সম্প্রদায়। সেই ভাবেই কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী, চটকি, কর্মকার, মাওয়াল, কাঠুরে, ধোপা, মুচিরাও। কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করেন পেশাজীবী বা প্রফেশনাল সম্প্রদায়ের কথাও। যেমন- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল, মোক্তার, হরিজন, ড্রাইভার, মাঝি, ইত্যাদি। তবে যতদুর জানা যায় এ সকল সম্প্রদায়ই মূলত একসময় ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে এসে একিভূত হয়ে বিলীন হয়ে যায়। তখন ধীরে ধীরে একটা বিশেষ নির্ধারণীর রূপ তৈরি হয়। সেটা অনেকটা আমাদের মুখস্ত। তা হলো হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রীষ্টান, পার্শি, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভিল, গারো। আরো কি আছে? আছে নিশ্চয়ই। তবে শেষটা শেষ পর্যন্ত কতজনে জানে? 

তাহলে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টা কি? নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সকল কর্মযোগইতো? সে হতে পারে ভালো কর্ম, কিংবা হতে পারে খারাপ। অথবা বলা যায় গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য কর্ম। তবে সকল সম্প্রদায়েরই কর্ম নির্ধারণীর কিছু বিশেষ উপকরণ সহযোগের নির্দেশনা থাকে। তাদের সেটা মেনে চলতে হয়। ধরুন মুসলিম সম্প্রদায়। তাদের পথ চলার মূল নির্দেশিকা কি? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে সেটা ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ¦, যাকাত। এর আছে আবার অনেক ধারা উপধারা। মুসলিম সম্প্রদায় তাকে মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। তেমনি প্রত্যেক ধর্মের বা সম্প্রদায়েরই এমন নির্ধারণী বিষয় অবশ্যই আছে। তবে আমি সেটার পূর্ণ কিংবা আংশিকও জ্ঞাত নই। কিন্তু অনুমান করি, বিশ্বাস করি, আছে। এবং তারা তার দ্বারা নির্ধারিত হয়েই সেই সকল ধর্মের চলতে হয় বা বলতে পারি চলে।

তবে এভাবেও সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। সেটা হলো কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়গুলোর অতিরঞ্জনকেও সাম্প্রদায়িকতা বলেন কেউ কেউ। আবার এভাবেও বলেছেন অনেকে, কোন সম্প্রদায়ের নিজস্বতাকে অন্য সম্প্রদায়ের উপর অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসে মত্ত হওয়া, কিংবা জোর করা বা নৃশংসভাবে বাধ্য করা। এমন আচরণকে সাম্প্রদায়িক বলতে পছন্দ করেন সব থেকে বেশি এ বিষয়ে চিন্তিত জন।

যুগযুগের ইতিহাস বলে সংখাগরিষ্ঠরা সর্বত্র এবং সর্বদাই লঘিষ্ঠের অনিষ্ট সাধনে মত্ত। কেন? মূলত এটা স্বভাব, অজ্ঞতা, স্বেচ্ছাচারিতা, অসহনশীলতা, আধিপত্যবাদ এবং নিয়ন্ত্রণে রাখবার এক ব্যার্থ প্রয়াস। এই সমস্যা পৃথিবীব্যাপি চিরদিনের। সাদার সঙ্গে কালোর, আমিরিকার সঙ্গে আফ্রিকার, ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার এবং বাঙালিদের সঙ্গে অবাঙালিদের। 

এ ছিলো পৃথিবীর আদিতে। তখন মানুষ মানুষের কৃতদাস ছিলো। সামন্ততান্ত্রিক প্রথার প্রচলন ছিলো, প্রচলন ছিলো জমিদারী প্রথারও। এ সকল প্রথারই মূল সুর ছিলো শক্তিশালী সম্প্রদায়ের প্রভাব তুলনামূলক দুর্বল সম্প্রদায়ের ওপর। ধীরে ধীরে সেই আদিম এবং মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক শোষণ, সময়ের প্রয়োজনে কেবল আধুনিক হয়েছে। আরো কঠিন, রূঢ়, নির্লজ্য এবং নিষ্ঠুর হয়েছে। হয়েছে রূপে, রঙে, ভাষায়, সাংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে এবং সবিশেষ সকল ধর্মীয় আদোলের রন্দ্রে রন্দ্রে। আর তাকে যথাযোগ্য অশ্লীল অবয়বে ফুলিয়ে ফাপিয়ে যথার্থ এবং সতেজ করে রেখেছে সময়ের রাজনীতি! শুধু দেশে নয়, এই উপমহাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। শুধু মাত্র রাজনীতি এবং ক্ষমতার দম্ভের প্রয়োজনে মানুষে মানুষে সম্প্রদায়ের বিভেদ সরব থাকবে চিরকাল। এর কোন বিনাশ নাই। এ কখনোই স্থবির হবে না। হতে দেওয়া হবে না। অর্থ, বিত্ত, রক্ত, শক্তি, ধর্ম যেখানে যার যখন প্রয়োজন হবে তাকে যথাযথ ব্যবহার করেই বাঁচিয়ে রাখা হবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ। কেউ রুখতে পারবে না একে-কোনদিন, কখনো, কোথাও। আমরা কেবল দেখবো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন হবে, বক্তৃতা হবে, মিছিল মিটিং হবে, লোক দেখানো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলিও চালাবে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কেবল তা দেখবে কিন্তু কিছুই বুঝবে না। অতএব এ কখনোই থামবে না, কখনোই কমবে না।

এই উপমহাদেশে ধ্যানে, জ্ঞানে, কর্মে, ধর্মে, অর্থনীতিতে, বিজ্ঞানে ভারত নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। তাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানও বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিত করে রাখে। ভেবেছিলাম ভারতই পারবে এই উপমহাদেশে এবং পৃথিবী জুড়ে মানবিক ভারত হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি সমুন্নত রাখতে। হলো না। চরমভাবে লাঞ্ছিত হলো সেখানে মানবতা। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভেদের রাষ্ট্রীয় রূপ দেওয়া হলো। দেখলাম মহাত্মা গান্ধীজীর ভারতে খোদ প্রধানমন্ত্রী তাদের ধর্মীয় উপাশনালয় মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করছেন। না, নিশ্চয়ই এটি কোন দোষের বেপার নয়। আজ বাংলাদেশেও এভাবে এমন একটি মসজিদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধক হতে পারেন মানীনয় প্রধানমন্ত্রী। হয়তো সেও হবে খুবই স্বাভাবিক। তবে একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রায়ের কোন উপাসনালয়ের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপনের দায়, তার পরেও রাষ্ট্র প্রধানের নয়। এটি সুখকর নয়, দৃষ্টিনন্দনও নয়। কারণ সেই সমাজে দেশে একজনও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ থাকলে সে খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত হয়। এ কথাটি, বিষয়টি খুবই মানবিক। তবে রাজনীতি তা বোঝে না। আর বোঝে না বলেই সাম্প্রদায়িক রূপধারী ভারত তার এই বিধ্বংসী রূপের উন্মেষ ঘটালো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের সংবিধানে ভারতে যে অসাম্প্রদায়িকতার আলো জ্বালিয়েছিল মহাত্মা গান্ধী। সেই আলো ২০২০ সালে এসে এল. কে আদভানী ও নরেন্দ্র মোদির হাত তা নিভিয়ে দিলো। সেই আলোহীন অন্ধকারে তারা ঘোষণা করলো এটি ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখলো এক সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয়, হিন্দুত্ববাদী ভারত।

এমন ঘোষণায় অযোধ্যায় বাপুর ভারত নিথর, নিস্তব্ধ, নির্বাক ও ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে দেখলো তা। দেখলো একটি সম্প্রদায়ের উপাশনালয় গুড়িয়ে দিয়ে রামভূমি নির্মাণের এমন অদ্ভুত অপকৌশল। পৃথিবী এর আগে আর কখনো কোথাও দেখেছে কী এমন বিষয়? হুবহু এমন রূপে! প্রথমে ভাঙলো বাবরি মসজিদ। দখল নিল তার সমস্ত জমি। দখলে নিল আইন আদালত। ঘোষিত হলো সেখানে অতি নিয়ন্ত্রিত নির্দেশিত এক রায়। সংক্ষুব্ধ হলেও মেনে নিতে বাধ্য হল সেখানকার সংখ্যা লগিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়। এভাবেই একদিন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো নিকট অতীতের এক নির্বাচনের পরে ভোলার হিন্দু সম্প্রদায়। পরবর্তীতে মেনে নিতে হয়েছিলো উখিয়া, রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এমন সাম্প্রদায়িক বিপর্যয়ের প্রভাব দেখেছিলাম নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চ-এ। এ সকলই সত্য। তার পরেও নির্মল কিছু সত্য থাকে। আর তা হল, এ সকল ঘটনার পরে আমরা সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যারা সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করি, তারা সেদিন রাস্তায় এসে এর প্রতিবাদে এক সঙ্গে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলাম। আমরা সেদিন সোচ্চার হতে পেরেছিলাম। যখন বার্মা থেকে সে দেশীয় সামরিক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান। যাদের আশ্রয়স্থল হয়েছিল বাংলাদেশ। তখন আমরা এদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সমস্বরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করতে পেরেছিলাম।

কিন্তু অসাধারণ এবং অদ্ভুতভাবে আজ যখন ভারতের অযোধ্যায় বাবরি সমজিদের স্থলে মন্দিরের শিলান্যাস করলো ভারত। তখন আমরা বিস্ময়করভাবে দারুন কুট-কৌশলে মুখে কুলুপ এঁটে চুপ রইলাম। কোথাও কোন কথা নেই। ‘যেনো অন্ধ চোখ বন্ধ হাত বান্ধা। কোন কথা নেই কেউ বলে না, কোন কথা নেই কেউ চলে না।’ বাধ্য হলাম বলতে এই নির্মম সত্য। কোথাও কোন আসাম্প্রদায়িক মানুষদের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। কেউ এসে বলল না এটা ঠিক নয়। কেউ এসে বলল না এর নামও সাম্প্রদায়িকতা। কেউ বলল না চলো, রাস্তায় দাঁড়াই, প্রতিবাদ করি। না বলল না। না সমাজ না সংস্কৃতি না রাজনীতি না রাষ্ট্র। তবে কি সদা-সর্বত্র অতি অসম্প্রদায়িক হওয়ার প্রয়াসে আমরা সবাই মূলত সাম্প্রদায়িকই রয়ে যাচ্ছি? পৃথিবীর সব দেশের এ জাতীয় বৈষম্যপূর্ণ সকল ঘটনার প্রতিবাদ করা যায়। আমরা প্রতিবাদী হই। ভারতের এমন আচরণের প্রতিবাদ করা গেল না। আমরা দারুনভাবে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুকে স¥রণ করাতে ব্যর্থ হলাম যে, এ নিদর্শন বন্ধুত্বের নয়!

অসম্প্রদায়িক ভারতের রাজনীতির দুর্বিপাক ২০২০ সালে এসে হিন্দুত্ববাদে বলিয়ান বিজেপিকে এই খেলায় বিজয়ী করলেও মূলত চরমভাবে পরাজিত করেছে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র করেছে, মহাত্মা গান্ধী, জওহারলাল নেহেরু, এবং আবুল কালাম আজাদের অসম্প্রদায়িক ভারতকে। পরাজিত হয়েছে ইন্দিরা গান্ধির ভারত, গনিখান চৌধুরীর ভারত, প্রনব মুখার্জী ও জোতিবসু ভারতকে। শেষ করে দিয়েছে ভারতের দীর্ঘদিনের অহংকার, দাম্ভিকতা এবং ব্যাপক শিক্ষিত জনের মানবিক বোধকে। ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বে অহংকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় এবং অমর্ত্য সেনদের মাথা। ঘৃণায় সংকোচিত হয়ে যাই যখন দেখি নির্দিধায় ভারতীয়রা সবাই  মানুষ নয়, জয় শ্রী-রাম বলে সকলেই নতুন করে হিন্দু বনে যাচ্ছে! আমরা বিস্মকরভাবে বুঝতে ব্যর্থ হলাম। কেনো ভারত চরম বৈষম্যপূর্ণতায় ভরা, সাজানো এই নাটকটি এভাবে উপস্থাপন করল? কেনো আইনের খেলাটি (যে রায়টি সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছিল) তারা একই সময় দুই জায়গাই খেললেন না। তারা তো পারতেন মুসলিম সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় মসজিদ নির্মাণের-ও উদ্যোগ নিতে। বিষয়টি এমন হলে অন্তত মন্দের ভালোটি প্রকাশ পেত।

হলো না। হয় না। এরই নাম যথার্থ সাম্প্রদায়িকতা। এর নামই সাম্প্রদায়িক উগ্র-রাজনীতি। যে রাজনীতির কাজ বরফকে বরফ হতে না দেওয়া। আগুনকে আগুনের রূপ দিতে না দেওয়া। পানিকে পানি হতে না দেওয়া। তেমনই এক শঠ রাজনীতির সফল রূপ দেখলাম সমগ্র ভারত জুড়ে। দেখলাম তাদের রাজনীতির তোর ধর্মকে ধর্মে থাকতে দিল না। চরম রাজনীতির উগ্র হাতিয়ার বানিয়ে তার সফল নির্লজ্জ প্রয়োগ ঘটালো সে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর।

আমরা যে ভূখন্ডে স্বাধীন সার্বোভৌম, সেখানেও সবাই ধোয়া তুলসী পাতা, বিষয়টা এমন নয় মোটেই। প্রয়োজন, পরিস্থিতি, রাজনীতিতে এমন অসভ্য রূপের জন্ম এখানেও দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো। পারেনি কারণ একটাই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অসম্পৃক্ততা, সচেতনতা এবং প্রতিবাদ। এমন দুষ্টু রাজনীতির বিরুদ্ধে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় চিরদিন অবিচল। তার পরেও তাদের দিকেই আঙুল তুলে তাদের ধর্মীয় সকল কর্মকে সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী বলবার এক অপচেষ্টা অনবরত চলমান আমাদের চারপাশে। শুধু জানা দরকার, বোঝা দরকার, বলা দরকার। সেটা খুবই স্পষ্ট অসম্প্রদায়িকতা মানে ক্যামাফেলেক্স নয়, পরম পরমত সহিষ্ণুতার অনুশীলন। চরম কোমলতার অনুশীলন। ধূর্ততা নয়, স্বাভাবিক সত্যের কাছে অনবরত নতজানু থাকা।

যারা প্রতিদিন আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা বোঝাতে চেষ্টা করেন। যারা সুযোগ পেলেই সভা সমাবেশ বক্তৃতার আসরে সর্বপ্রথম এই বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ থাকতে বলেন। তারা নিজেরা কি জানেন, বোঝেন, ভেবে দেখেছেন কি কখনো? তারা নিজেরা আদৌ অসম্প্রদায়িক কি না? অথবা অসম্প্রাদয়িক শব্দের অর্থরূপ বুঝতে পারেন কি না? নাকি এটি শুধুমাত্র একটি শব্দ যা উচ্চারণ করলে বারবার, এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্তিতে রাখা যায়। নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখা যায়। যাতে করে অনবরত একটা চাপের মধ্যে থাকে দেশ?

মূলতঃ আমরা কেউই চাই না একটি সত্যিকারের অসম্প্রদায়িক পরিবেশ। কারণ সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িকতা প্রচন্ড এক সত্যির-শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত অতি তীক্ষ্ণ তির্যক এক বিষয়। সেখানে কোন স্বার্থ, হোক সে হীন, ক্ষীণ কিংবা অতি ক্ষুদ্র, তার প্রয়োগের কোন স্থান নাই। সেখানে কোনই স্থান নাই শঠতার। হোক সে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক অথবা  ধর্ম। 

কোন নির্দিষ্ট ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দেশে কোন নির্দিষ্ট রাষ্টীয় ধর্ম ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, আদৌ আছে কি? তাতে কতটুকু বৃদ্ধি পায় ধর্মের প্রচার, প্রকাশ কিংবা মহিমা? এ জাতীয় প্রশ্নের মূলত কোন যোগ্যতর উত্তর নেই। যা আছে সেটা বোকামি, অযোগ্যতা এবং রাজনীতি। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অতীত নির্বাচন উত্তর ভোলা, পরবর্তিতে রামু , উখিয়া, নাসির নগর। যে সকল ঘটনা ঘটেছে আমরা তা ভুলি নাই। আমরা ভুলতে পারি না সেই সকল জনপদে ঘটে যাওয়া বিভৎস সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক উৎপিড়ণের কথা।

এই মুহূর্তে ভারতে জয়শ্রী-রামের যে ব্যাপক বল প্রয়োগ। অযোধ্যায় বাররি মসজিদের স্থানে মন্দির স্থাপনের যে রাষ্টীয় উদ্যোগ, একই সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানর ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে অপ্রাসঙ্গিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসনের আওতায় আনা হলো। একে কি বলবো? পাকিস্তানে নিত্য শিয়া-সুন্নির যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-দ্বন্দ্ব। বার্মায় আরাকান প্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর যে মধ্যযুগীয় হামলা এবং যেভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইষ্ট চার্চে জুমার নামাজে যেভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হলো। একে কি বলবো? শুধুই রাজনীতি, তার সার্থক নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রদায়িকতা কি নয়? চীনে কি হচ্ছে উইঘোর মুসলিমদের সঙ্গে, তাকে কি বলা যায়?

তুরস্কে কি করছেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগান? নিশ্চয়ই এ সবই রাজনীতির মোড়কে সাম্প্রদায়িকতার চর্চাই। আর সে ক্ষেত্রে রাজনীতির সব থেকে সহজ উপকরণ ধর্ম বা ধর্মের রয়েছে বিধ্বংসী ব্যবহার। যার উপরে ভর করে, যাকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় ক্ষমতা নামক দুর্লভ দম্ভ! সেখানে সামান্যতম ভিন্নতা নেই কারোরই। পৃথিবীর দেশে দেশে এদের সবার রূপ এক এবং অভিন্ন। ভিন্নতা শুধু প্রয়োগিক আঙ্গিকের। যদিও আমরা আমাদের চারপাশে বিষয়টিকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, বিভাজন হিসেবে দেখতেই বেশি অভ্যস্ত। মসজিদ মন্দির বিভাজনের গল্প হলেই যেনো ভালো বুঝতে পারি।

অথচ এর বাইরেও বিষয়টি নিখুঁত বিস্তৃতি নিয়ে দারুনভাবে সরব আছে। তাকে নিয়েও বলা যায়, বলা উচিৎ।  তা না হলে অসাম্প্রদায়িক মানুষ এবং সমাজ গড়ার যে অনুশীলন তাতে খাদ থেকে যায়। তেমনই এক রূপ যা মূলতঃ আমাদের দৃষ্টির এবং চিন্তারও অনেক বাইরে রয়ে যায়। বিষয়টি তুরস্কের স্তাম্বুলের। সেখানকার একটি মসজিদ যাকে এক সময় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে চার্চ বানিয়েছিলো, সেখানকার অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা। পরবর্র্তীতে পরিবর্তীত অবস্থায় অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ কামাল আতাতুর্কের সময় ওই চার্চকে পুনরায় বানানো হয় যাদুঘর। সেটিও করেছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তদানিন্তন তুর্কী মুসলিমরাই। সেই যাদুঘর যা কিনা একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বাতিঘর। সেই জাদুঘরটি হাজার বছরের পুরনো। পুরাকির্তীর দিক থেকে যে জাদুঘর ভবনটির অবস্থান হায়া সোফিয়ার পরেই। সেটিও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান গত ২২-০৮-২০২০ তারিখে পুনরায় মসজিদ হিসেবে খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন! এর মাত্র এক মাস আগে তুরস্কের আদালতের রায়ে, স্তাম্বুলের ক্ষ্যাতনামা হায়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। ১৫০০ বছরের পুরানো এই স্থাপনা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হায়া সোফিয়া, যা এক সময় খ্রিষ্টান ক্যাথেড্রোল ছিলো। এ সকলই আজ বিশ্ব খবরের অংশ। একে কি বলা যায়, ধর্মের প্রসার নাকি প্রচার? নাকি এটাই সাম্প্রদায়িকতার মূল ধারণা? এভাবেই চলছে জেরুজালেমে ইজরাইলের ইহুদিরা বারবার আটকে দিচ্ছে প্যালেস্টাইনে বিশ্ব মুসলিমদের অতি পবিত্র আল-আকসা মসজিদে প্রবেশের পথ!

আমরা অনেক বলতে পারি। হয়তো বলিও। তাতে কিছু হয় কি? বিশ্ব সম্প্রদায়ের কোন এক জনও কি তাতে অন্যের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিশীল হয়, আমরা কি হই? না, হই না। কেউ একজনও হই না। আমরা সবাই মূলত এক নষ্ট সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা আবিষ্ট থাকি। হয়তো চেষ্টা থাকে, তবুও পারি না এ জাল ছিঁড়তে। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি স্থান, কাল, পাত্রভেদে। আর এই যে না পারার অভ্যাস তাকে সচল রাখে আমাদেরই দুর্বল মন, অপবিত্র আত্মা। আত্মার পরিশুদ্ধতা ছাড়া মানুষ মানুষের প্রতি কখনোই সহানুভূতিশীল হতে পারবে না। মানুষের কর্মোদ্যোগের মধ্যে বিন্দু-বিসর্গ দুষ্টামী থাকলে, ধর্ম এবং বর্ণের বিদ্বেষ থাকলে অনেক কিছুই হওয়া যাবে। হয়তো হতেও পারবো। তবে আখেরে যথার্থ মানুষ হওয়া আর হবে না। যে কারণে এই মুহূর্তে সাহস করে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, সেটা হলো মূলত এখন আমরা কেউই আর মানবিক গুণ সমৃদ্ধ মনবিক বোধে আবিষ্ট মানুষ-ই নই।
 
তার পরেও সকালের যে ফোন কলটি আমাকে যে সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিলো, আমি তা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অসাম্প্রদায়িকতার আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। যে কারণে পৃথিবীর অন্য কোন দেশের, কোন খবর কিংবা কোন কার্যক্রম আমার স্বীয় সিদ্ধান্তের এবং বিশ্বাসের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এ কারণেই সবার জন্যই সমান সত্য, তা হলো বরিশালবাসীর এই চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে জয় পরাজয়ের কোন সম্পর্ক নেই। হলেও আমরা বিজয়ী হবো না, না হলেও আমরা কেউ পরাজিত হবো না। এ শুধুই আমাদের সবার জন্য মহাত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের সুযোগ। আমরা যেনো সেই কাজে ব্যর্থ না হই। তা যদি না পারি। যদি আরো বিরোধীতায় জড়িয়ে যায় বিষয়টি। যদি এই বরিশাল দেখতে বাধ্যই হয়, সকল স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বাধ্য হয়েছে এর বিরোধীতায়। তারা হাজার হাজার জড় হয়ে ধ্বনি তুলছে রাস্তায় ‘আমরা এই শহরে অশ্বিনীর নাম চাই না।’

কি আর করবো তখন, মুখে চুন মেখে সঙ সেজে, ধেই ধেই করে নাচবো। আর গাইবো-
‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাশে,
গাছে গাছে গাধা নাচে, 
কতো ছাগল চারিপাশে।
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাশে।’
যারা ধ্যানে জ্ঞানে এখনো উদীচী চারুকরার বিভেদকে এই অশি^নী বিষয়ে সরব রাখতে বদ্ধপরিকর আছেন, আমি ঠিক জানি না এর ভবিষ্যৎ। কি জানি, হতেও তো পারে এই আন্দলনের প্রয়োজনেই, মহাত্মা অশ্বিনী কুমারই আবার আমাদের একত্রে দাঁড় করিয়ে দিবেন পাশাপাশি একই মঞ্চে। কোন এক মঙ্গল প্রভাতে মহাত্মার হাতে গড়া ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের মাঠে? তবে কেনো বিশ্বাস করবো না সরকারি বরিশাল কলেজের নামের সঙ্গে মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নাম সংযুক্ত হবেই এবং প্রমাণ হবেই বর্তমান দেশ, সকল সম্প্রদায়, সরকার সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক।


লেখক: সাংস্কৃতিক সংগঠক, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য