নেহেরুকে লেখা মুজিবের চিঠি ছিল ভারত সরকারকে শেকড়সহ কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো

নেহেরুকে লেখা মুজিবের চিঠি ছিল ভারত সরকারকে শেকড়সহ কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি হস্তান্তর করে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জিকে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে সমমর্যাদার বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন চাইছি। মাথা নত করে হাত পাতছি না। চীনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ভারত এখন দুনিয়ায় ইজ্জত হারিয়েছে। আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা ন ফিরে আসবে, মর্যাদা যেমন বাড়বে; তেমনি আমার বাঙালি স্বাধীন আবাস ভূমি পাবে। আমরা স্বাধীন হব।’ সেই সময় পূর্ববাংলার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপ-দূতাবাসের রাজনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেছেন। ১০ জুলাই সামারের চমৎকার বিকালে তাঁর লন্ডনের বাসভবনে টানা দুই ঘণ্টা তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। ৮৬ বছর বয়স্ক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। পরিপাটি সুন্দর বাড়ির পেছনে পিউলিপ, গোলাপসহ বাগান হরেক রকমের ফুলে প্রস্ফুটিত। সেখানে দাঁড়ালে ফুল আর ফুল দেখতে দেখতে মন জুড়িয়ে যায়। আমার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি আ স ম মাসুম ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির দুই ছেলে ক্যামব্রিজ পাস করে একজন ওয়াশিংটনে আরেকজন লন্ডনে পরিবার-পরিজন নিয়ে কর্মরত। দেয়ালে তাঁর গোটা পরিবারের ছবিসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১০ জানুয়ারি ’৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাশাপাশি সিটে বসা ছবিখানি উজ্জ্বল হয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছিল। ১৯৫৫ সালে ফরেন চাকরিতে যোগ দেওয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জি ’৮৫ সালে অবসর নেন। ’৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এমন সুপুরুষ, এমন কণ্ঠ ও ভাষার বক্তৃতায় একজন অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক ও অমায়িক ব্যবহারের বিচক্ষণ নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেছেন, ১৯৬০ সালে তাঁকে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে ভারতীয় উপ-হাইকমিশনে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় আসার আগে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যদিও তখন আওয়ামী লীগ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৬২ সালের ২৫ মার্চ ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসব। তখন তিনি পুরান ঢাকার চক্রবর্তী ভিলায় বসবাস করেন। বাড়িটির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক অফিস। ২৪ ডিসেম্বর রাতে তিনি তাঁর সহধর্মিণীসহ এক সহকর্মীর বাসায় বড়দিনের আনন্দ অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ শেষে রাত ১২টার পর পর বাসায় ফিরে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পান। দরজা খুলে দেখেন ১৪ বছরের এক ভদ্র, বিনয়ী অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে। সালাম বিনিময় করে সেই কিশোর ছেলেটি তাঁকে বললেন, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আপনাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছেন। দরজা খোলার আগে কড়া নাড়ার শব্দে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, মধ্যরাতের পর এই অসময়ে কে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। তিনি ভাবছিলেন, কেউ কি তাঁকে অনুসরণ করছিল? ঢাকায় আসার আগে তাঁকে নিজের এবং পরিবারের অতিরিক্ত নিরাপত্তায় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখা নিয়মিত পড়ে মুগ্ধ হলেও কখনো দেখা হয়নি। ছেলেটি আরও বলল, মানিক মিয়ার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক আছেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোক কে? সেটি ছেলেটি আর বলল না। তিনি ইতস্তত করে করে গোলকধাঁধার মতো মানিক মিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বসলেন। যা ছিল প্রথাবিরোধী। ব্যানার্জি বলেন, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, “যাই ঘটুক না কেন আমি সেই অজানার উদ্দেশ্যে যাব।” ছেলেটিকে বলে দিলেন, চলে যেতে এবং মানিক মিয়াকে জানাতে যে, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখা করতে আসছেন। এমন একটি সাক্ষাতের জন্য গভীর রাতে প্রস্তুত না থাকলেও শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি কিছুক্ষণ পর মানিক মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে ইত্তেফাক ভবনে গেলেন। তিনি শুধু আঁচ করলেন, বৈঠকটি যে রাজনৈতিক হবে এ নিয়ে তাঁর সন্দেহ নেই। তবে এ জন্য তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, “আমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে করমর্দন করে অস্বাভাবিক মুহূর্তে দেখা করতে আসায় ধন্যবাদ জানালেন। তিনি আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করলেন এবং তাঁর পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে ফিরে, হাতের ইশারায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তাঁর ছবি পত্রিকায় দেখেছি। তাঁর ভাষণ শুনেছি এবং চেহারা খুবই পরিচিত। আমার মনে হলো, এই ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম আমার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হলো। আমাকে বলতেই হবে, এতটা কাছ থেকে তাঁকে দেখার পর তিনি তাঁর ক্যারিশমা দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। ঈুৎরষ উঁহহ নামে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার পর বলেছিলেন, ‘মুজিব সুপুরুষ ছিলেন এবং তাঁর ছিল দারুণ ব্যক্তিত্ব।’ তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন। আমি দূর থেকে পল্টন ময়দানের গণসমাবেশে শেখ মুজিবের ভাষণ শুনেছি। আমি জানতাম, শক্তিশালী বক্তব্যে তিনি কেমন করে ¯্রােতাদের বেঁধে রাখেন। সেই সময় আমি শেখ মুজিবের ভাষণ ও মানিক মিয়ার লেখনী থেকে বাংলা ভাষা শিখেছি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এমনকি তাঁদের আমার বাংলা ভাষার শিক্ষকও বলা যায়। পরিচয়ের সময় মুজিব শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাঁকে বললাম, আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে তুমি বলতে পারব না। শেখ মুজিব আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন ভীষণ জরুরি একটা কিছু বলার জন্য তিনি উসখুস করছেন। হাসিমুখে চোখ মিটমিট করে তাঁকে বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। তবে জানতে চাইছি, এটা কি একটি ঐতিহাসিক করমর্দন? শেখ মুজিবের ত্বরিত জবাব ছিল, কেন নয়? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলেছিলেন, এই সোভিয়েত নেতার সঙ্গে পশ্চিমের লেনদেন সম্ভব। তেমনি ওই সময়ে আমার মনে যে কথাটি গোপনে দানা বেঁধে উঠেছিল, সেটি হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারতের লেনদেন সম্ভব।’ সেদিন শেখ মুজিবের পরনে ছিল লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে সোয়েটার। শেখ মুজিবকে বললাম, আমি অধমের সঙ্গে আপনি কেন দেখা করতে চাইলেন? কেন ডাকলেন? তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। আমি প্রশ্ন করলাম, গণতন্ত্রের জন্য কি ভারতের কাছে সাহায্য চান? তিনি কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, না। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করলেও আমি পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে যেটির কথা চিন্তা করছি, সেটি শুনলে চমকে উঠবেন না তো? আমি বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছি। শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি শুধু চমকেই যাইনি, রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যদি জানে মেরে ফেলবে। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা প্রকাশ হবে না তো! প্রকাশ হলে দেশদ্রোহী মামলা হবে। সাবধান, এভাবে ওপেন বলবেন না। আপনাদের প্রাণ তো যাবেই; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকুন, আমার তরফ থেকে এটি ফাঁস হবে না। তিনি বললেন, তাদের তরফ থেকেও ফাঁস হবে না। সেদিন এই দুই মহান ব্যক্তির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাঁদের কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি মানসিকভাবে জড়িয়ে ছিলাম।