প্রধানমন্ত্রীর উপহার, এক গজ কাপড়ে ১০ জনের পোশাক

সারা দেশে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ভূমিহনীদের জন্য নির্মাণ করা দুই কক্ষের ঘর ব্যাপক আশা জাগিয়েছিল। ঘরগুলো দেখতে অসাধারণ। উপর থেকে তোলা ছবি দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। বাস্তবে স্বল্প বরাদ্দে ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে কেবল রঙের আস্তরণের চাকচিক্য ঢাকা পড়েছে প্রকল্প। একই সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের নীচু এলাকায় ঘর নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা এবং নি¤œমানের কাজ হওয়ায় বেশিরভাগ ঘর নির্মাণের আগে ও পরে ভেঙে গেছে। বাস্তবে ঘরগুলো একমদই টেকসই হয়নি। প্রশ্নের মুখে পড়েরেছ পুরো প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রীর উপগহারের ঘর নির্মাণ এবং বরাদ্দ দেওয়া দেখে দুটি গল্প মনে পড়েছে। একটি হচ্ছে গ্রাম্য প্রবাদ, ‘ভিক্ষার চাল কারা, আর আকারা (ছাঁটা)’। অন্যটি এক গজ কাপড় দিয়ে ১০জনের জন্য পোশাক বানানোর গল্প। কেউ কেউ দ্বিতীয়টিকে কিপ্টের কারবার বলে থাকেন।
প্রথমটি হচ্ছে এক ভিক্ষুক ভিক্ষা করতে গিয়ে গৃহস্তের দেওয়া চালের মধ্যে ধান এবং ময়লা (ভালোভাবে ছাঁটা হয়নি) দেখতে পান। তখন ভিক্ষুক গৃহকর্তাকে বলেন চালের মধ্যে ধান এবং চালটা পরিষ্কার নয়। ভিক্ষুকের এমন কথা শুনে গৃহকর্তা রেগে গিয়ে বলেন, ‘করছ ভিক্ষা, যা পাও সেটাই নেও। ‘ভিক্ষার চাল আর আকারা’। মানে ভিক্ষার চাল (বিনামূল্যে) ভালোভাবে ছাঁটার দরকার নাই, এমনটাই বোঝাতে চেয়েছেন গৃহকর্তা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার পেতেও কাউকে টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়নি। অসহায় এবং ভূমিহনীদের জন্যই ওই ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘর যেমনই হোক ঘর তো নির্মাণ হয়েছে। সেটা নিয়ে তো আর অভিযোগ দেবার কথা নয় ঘর পাওয়া ভূমিহনীদের। কিন্তু তারা অভিযোগ দেওয়ার আগেই ঘরগুলো বেদনার বালুচরে বানানো ঘরের মতে ধসে পড়ছে। এমন অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। উঠেছে অনিম-দুর্নীতির অভিযোগও।
দ্বিতীয় গল্পটি বলে অন্যদিকে যেতে চাই। এক ব্যক্তি এক গজ কাপড় নিয়ে দর্জির কাছে গেলেন তাঁর এক সন্তানের জন্য একটি জামা বানানাতে। দর্জি নিয়ম অনুযায়ী গ্রহকের কাছ থেকে মাপ রেখে তাকে বিদায় করে দিলেন। জামা বানাতে আসা গ্রহক কিছু দূর গিয়ে ভাবলেন, কাড়প বোধহয় বাঁচবে, যা দর্জি চুরি করবে। একটুবাদে ওই গ্রাহক ফিরে এলেন এবং দর্জি বললেন, আমার ছেলের জন্যও একটি জামা বানাতে হবে। দর্জি এবারও মাপ রখে তাকে বিদায় দিলেন। কিন্তু কাপড় চুরির বিষয়টি গ্রাহকের মাথা থেকে যায়নি। তিনি পুনরায় ফিরে গিয়ে দর্জিকে ওই কাপড় দিয়ে আরো একটি জামা বানাতে বলেন। দর্জি তাতেও রাজি হন। এভাবে একে এক ১০টি জামা বানাতে বলেন গ্রাহক। নির্ধারিত দিনে জামা নিতে আসেন গ্রাহক। দর্জি তাকে ১০টি জামা দেন। গ্রাহক দেখন ১০টা জামা হয়েছে ঠিকই, তবে তা মানুষের পড়ার জন্য নয়, পুতুলের জামা হয়েছে। রেগে গিয়ে গ্রাহক বলেন এটা কি হলো? দর্জি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ১ গাজ কাপড় দিয়ে ১০টি জামা বানালে এমনই তো হয়।’
এবার আশা যাক আমাদের বিনা খরচে পাওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য উদ্যোগ হচ্ছে গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্যি জমিসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়া। যা দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। ঘরগুলোর নকশাও সুন্দর হয়েছে। নির্মাণের পর টপভিউ অসাধারণ। ঘর পেয়ে খুশি হয়েছেন গৃহ ও ভূমিহীনরা। সুন্দর ঘর নির্মাণ করে দেওয়ায় সাদুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু খুশির ঘর কয়েক মাসের মধ্যে অশ্রুজলে ভাসবে এমনটা কারো প্রত্যাশা ছিল না।
গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে যে খবর উঠে এসেছে তাতে দেখা গেছে মজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘর ধসে পড়েছে। কোথাও আবার যাবার রাস্তা নেই। ঘরগুলো ভাসছে জলের ওপর। দীর্ঘ ফাঁটল এবং উপর থেকে পানি পরাসহ নানা সমস্যা। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়ার ঘর ধসে পরা এবং অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় নরেচরে বসেছে প্রশাসন। ইতিমধ্যে বেশকয়েকজন কর্মকর্তা ওএসডি হয়েছেন। অনিয়-দুর্নীতির অভিযোগে কারো কারো চাকুরী হারানোর আশঙ্কাও রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
এমন সুন্দর ঘর নির্মাণ করার পরও কেন এমন হলো? তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে গোড়ায়। যারা এই ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা এবং অর্থ বরাদ্দ করেছেন সেখানে সমস্যা হয়েছে। যেখানে একটি ছোট্ট কক্ষ নির্মান করতে ২-৩ লাখ টাকা খরচ হয়। সেখানে দুই কক্ষের একটি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭১ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘরের জন্য ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এত অল্প বরাদ্দে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যা হবার তাই হয়েছে ও হচ্ছে। বরাদ্দকৃত ১ লাখ একাত্তর টকা কিন্তু ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়নি। এখানে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যদি ১০ ভাগ লাভ করেন তাহলেও ১৭ হাজার টাকা বাদ যাবে। তবে আমাদের দেশের ঠিকাদাররা এতটা নির্লোভ হবেন এমনটা আশা করাও ভুল। ঠিকাদার এবং অফিস খরচসহ কমপক্ষে ৩০ ভাগ বাদ দিতে হবে। সব মিলে ৫১ হাজার টাকা বাদ দিতে হবে। তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই অর্থ দিয়ে দুই কক্ষের ঘর নির্মাণ করা সম্ভব? এটা ভেবে দেখতে হবে। আর ঠিকাদার যদি লাভ আরও বেশি করেন তাহলে তো কথাই নাই। এত অল্প খরচে ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে কেবল বালুর ওপর নির্ভর করেই নির্মাণ করা হয়েছে ঘর। রড এবং অন্যান্য সামগ্রি ছাড়া গৃহ নির্মাণ হওয়ায় নির্মার্ণের আগে ও পরে তা ধসে পড়েছে। কিন্তু এখন এর দায় গিয়ে পড়ছে দেখভাল করা কর্মকর্তাদের ওপর। তাদের শাস্তিও হচ্ছে। আমরা বলছি না যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ নেই। তবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে কতটা দুর্নীতি করা সম্ভব সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
সারা দেশে গরীবদের জন্য বাড়ি বানানো হয়েছে। ওই প্রকল্প দেখে এমনটা মনে হয়েছে, কত কম দামে বাড়ি বানানো যায় তার একটা প্রতিযোগিতা হয়েছে। ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন মূল প্রকল্প নির্মাতারা। কর্তৃপক্ষকে খুশি করারই ছিল তাদের কাজ।
অভিযোগ উঠেছে, দেশে যেখানে প্রাইভেট কোম্পানি প্রতি বর্গফুট নির্মাণের ১০ হাজার টাকা নিচ্ছে। সরকারি খরচ অতটা হবে না এটা ঠিক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিলেও ঘর নির্মাণে, মানে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে এলজিইডির যে এস্টিমেট আছে এখানে তা অনুসরণ করা হয় নাই। একই সঙ্গে গণপূর্তর এস্টিমেটও ফলো করা হয় নাই। প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর নির্মাণে পাইলিং করা হয় নাই, মাটি কমপ্যাক্ট করা হয় নাই, লিংকার বা লিনটন করা হয় নাই, লোহা বা রড ব্যবহার নাই। ঠিকাদার লাভ ছাড়া কাজ করবে ভাবা যায়? তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে, এটার জন্য সাজা হতে পারে যিনি এই এস্টিমেট করেছেন কিংবা তৈল মর্দন করে কর্তৃপক্ষকে খুশি করার জন্য এগুলো করেছেন, তাদের। এখানে বরাদ্দ বাড়িয়ে টেকসই ঘর নির্মাণ হওয়া দরকার। সেক্ষেত্রে ঘরের সংখ্যা কম হলেও ক্ষতি নেই।
আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া একটি অনন্য উদ্যোগ যেন, কালো তিলকে ঢাকা পড়ে না যায়। মানুষ যেন কণ্ঠ বাড়িয়ে বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘর টেকসই হয়েছে। আগামী ৫০ বছরেও ঘরের কোন ক্ষতি হবে না। তা না হলে প্রশ্নউঠবে এবং অনভিজ্ঞ কিছু কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিরা কেবল দোষের ভাগীদার হবেন। আত্মসম্মন ও আত্মমর্যাদা হারিয়ে মানসিক বৈকল্যের শিকার হবে।