বরিশাল কলেজকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ নামকরণ বাস্তবায়নের দাবি

বরিশাল কলেজকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ নামকরণ বাস্তবায়নের দাবি

সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার স্মৃতি সংসদ। অশ্বিনী কুমার দত্তের অবদান এবং তাঁর বাড়িতে নির্মিত বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে অশ্বিনী কুমারের নামে করার চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সবাইকে থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন।

আজ (১২ জুলাই) রোববার দুপুর ১২টায় বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ওই আহ্বান জানায় অশ্বিনী কুমার স্মৃতি সংসদ।

মহাত্মা অশ্বিনী কুমার স্মৃতি সংসদের সভাপতি  স্নেহাংশু বিশ্বাস লিখিত বক্তব্যে বলেন, আজকের সরকারি বরিশাল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় এটি ছিল নৈশ কলেজ। এই কলেজের প্রথম শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ব্রজমোহন (বিএম) বিদ্যালয়ে। তখনকার বিএম স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত দীর্ঘদিন বাংলা পড়াতেন এই কলেজে। তখন অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনটি ছিল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের কসমোপলিটন হল। এখানে সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা থাকতেন। পরবর্তী সময় নৈশ কলেজের যাত্রা এই বাড়িতে হওয়ার পর ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাসের কার্যক্রম এখান থেকে সরিয়ে নেয়। সেই থেকে বরিশাল নৈশ কলেজ এবং পরবর্তী সময় দিবা-নৈশ এবং বর্তমানের সরকারি বরিশাল কলেজ নামে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শুরু থেকেই কলেজের নাম পরিবর্তন করে অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে করার দাবি ছিল।

২০১২ সালে সংসদেরও এই দাবিটি উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দাবী বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বছর অশি^নী কুমার দত্তের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে কলেজ চত্বরে অনুষ্ঠিত মেলার আলোচনা সভায় পুনরায় দাবিটি উত্থাপন করা হয়। ওই দাবির প্রেক্ষিতে বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজির রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এব্যাপারে বরিশাল সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং কলেজ প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে তিনি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই চিঠির ইতিবাচক সাড়া দিয়ে নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরপর কোন একটা পক্ষ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। কেন তারা বিকক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন সেটা বোধগম্য হচ্ছে না।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন অভিভক্ত ভারতের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, মহান শিক্ষাব্রতী, সমাজসবী, লেখক, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক, বরিশাল এর নবজাগরণের অগ্রদূত মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত’র জন্ম ১৮৫৬ সালর ২৫শে জানুয়ারি  পিতার কর্মস্থল পটুয়াখালীতে। তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার, ভাইস চেয়ারম্যান  এবং পরবর্তীত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই প্রকৃত অর্থে আধুনিক বরিশাল এর নির্মাতা  এবং ব্রিটিশ বিরাধী আন্দোলনের অন্যতম পুরাধা ব্যক্তিত্ব।

সত্য-প্রেম-পবিত্রতার প্রতীক মানুষটি অবিভক্ত ভারতবর্ষে বরিশালকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্যতম প্রধান পীঠস্থানে পরিণত করেন। তাঁর জন্যই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বরিশাল ব্রিটিশ সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী মানুষটি আজীবন সুখে-দুঃখে অসহায় মানুষের সহায় হয়ে, বিপদে-আপদে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আমজনতার মনের মণিকোঠায় স্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন।

আশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশাল কালিবাড়ি রোডে নিজস্ব ভবনে বসবাস করতেন। ১৯২২-এর আগস্ট মাসে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি কলকাতা যান এবং ১৯২৩-এর ৭ নভেম্বর ডাক্তার নীলরতন দে-র চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই বাড়িটি ছিলো একটা বড়ো দোতলা বাড়ি যার উপরে চিলেকোঠা সংলগ্ন দুটি কক্ষ। দোতলার প্রতি তলায় ছিলো ছয়টি করে কক্ষ এবং একটি বড় হলঘর, সামনে পিছনে বারান্দা; পিছনের বারান্দার সাথে রান্নাঘর, রান্নাঘর। বাড়ির প্রধান ফটকে ঢুকতে ডান দিকের স্তম্ভে ছোটো নাম ফলকে লেখা ছিলো ‘অশ্বিনী ভবন কালীবাড়ী রোড, বরিশাল’। 

আশ্বিনীকুমার দত্তর মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের ছেলে সরল দত্ত এই বাড়িতে বসবাস করতেন। সরল দত্ত দেশ থেকে চলে যাবার সময় এই বাড়িটি ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে যান। ১৯৬৭ পর্যন্ত এটি ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দুই তলায়ই ছাত্র থাকতো আর উপরে চিলেকোঠা সংলগ্ন কক্ষদ্বয় ব্যবহৃত হতো ছাত্রবাসের তত্বাবধায়কের আবাস হিসেবে। এই ছাত্রাবাসের তত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম এবং বাংলা বিভাগের আসাদুজ্জামান এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক। ‘অশ্বিনী ভবন ছাত্রাবাস নামেই ছিলো এর পরিচিতি।  

১৯৬৩ বরিশালের কিছু উদ্যোগী ব্যক্তি মূলত বরিশাল কালেক্ট্রটে কর্মরত কয়েকজন অফিস-সহকারী একটি নৈশ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এদের একটি প্রতিনিধি দল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়ন্তকুমার দাশগুপ্তের সাথে সাক্ষাত করে বিষয়টি জানান। জয়ন্তকুমার দাশগুপ্ত তাঁর বিদ্যালয়ে নৈশ কলেজ শুরু করার সম্মতি দেন এবং শুরুতে ব্রজমোহন বিদ্যালয়েই নৈশ কলেজের ক্লাস হতো। কলেজের নামকরণ করা হয় ‘বরিশাল নৈশ কলেজ’ বা ‘বরিশাল নাইট কলেজ’। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়ন্তকুমার এই কলেজে বাংলা পড়াতেন। ব্রজমোহন কলেজের কয়েকজন শিক্ষক এই কলেজে শিক্ষাদান করতেন। নৈশকলেজে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে গেলে পৃথক ক্যাম্পাসের প্রয়োজন হয়ে পরে। তখন সবাই মিলে নৈশকলেজ অশ্বিনী ভবনে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত ১৯৬৭-তে নৈশ কলেজ অশ্বিনীভবনে স্থানান্তরিত হয় এবং ব্রজমোহন কলেজ ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে যায়। এসময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আবদুল হক। ১৯৬৮/১৯৬৯ সালে নৈশ কলেজে ‘দিবাভাগ’ খোলা হয়। তারই ধারাহিকতায় এর নাম ‘বরিশাল নৈশ কলেজ’ থেকে ‘নৈশ’ শব্দাট বাদ দিয়ে নামকরণ হয় ‘বরিশাল কলেজ’। আবদুল হকের পর অধ্যাপক সিরাজুল হক এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন আলী এই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় প্রেসিডেন্ট হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ বরিশালে নির্বাচনী জনসভায়  শহরের দুটি কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ ও বরিশাল কলেজ, জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭.১১.১৯৮৬ জারিকৃত এক আদেশনামায় কলেজ দুটি জাতীয়করণ করা হয়। ফলে বরিশার কলজের নামের আগে যুক্ত হয় ‘সরকারি’ শব্দটি। এভাবেই সরকারি বরিশাল কলেজের সৃষ্টি। এতসব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে কলেজটি মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নামে নামকরণে দাবি ওঠে। এই দাবির পক্ষে সবাই একাট্টাও হয়।

লিখিত বক্তব্যে স্নেহাংশু বিশ্বাস বলেন, ২০১২ সালে তৎকালিন সংসদ সদস্য বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো: ইউনুস জাতীয় সংসদে সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণের প্রস্তাব করেন। বরিশালের জেলা প্রশাসক গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। গত ২৯ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডকে সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণের যৌক্তিকতা উল্লেখ করে সুপারিশ প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে। আমরা চাই, সবাই মিলে মহাত্মা অশি^নী কুমার দত্তের বাসভবনে নির্মিত বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নামে করার সঙ্গে একাত্ম হবো।