হারাম-হালালের দ্বন্দ্ব ঘুঁচবে কেমনে

আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনের কাঠের দরোজার দুই পাল্লায় নিখুঁতভাবে খ্ােদাই করা দুটি পাখি আঁকা রয়েছে। যিঁনি এই নান্দনিক কাজ করেছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। কারণ কাঠের ওপর এমন সুন্দর কাজ যিনি করেছেন তিনি নিসন্দেহে সৃষ্টিশীল মানুষ। দুটি পাখি একটি কলশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা বিকৃতভাবে এখনো শোভা পাচ্ছে। কারণ, নকশা করা পাখি দুটির ঠোঁট কেটে তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। না, কোন শিশু এ কাজ করেনি। করেছে বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। ঠোঁট খুঁচিয়ে তুলে দেওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে। ওই অবস্থায় পাখি দুটি আজো দরোজায় শোভা পাচ্ছে। কেন এত সুন্দর পাখির ঠোঁট কেটে সৌন্দর্যহানি ঘটানো হলো তার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে।
আমাদের বড় মামা (বৈামাত্রিক) অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ ছিলেন। অনেক বড় বাড়ি তার। বাড়ির চার দিক কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া থাকতো। কারণ ওই বাড়ির মেয়েদের যেন কেউ দেখতে না পায়। কলাপাতা এমনভাবে উঁচু করে দেয়া হতো, অনেকটা সুউচ্চ প্রাচীর মনে হতো। এটা হচ্ছে নিখাদ পর্দার সিম্বল। আমাদের ওই মামতো বোনরা বাড়ির বাইরে গেছেন এমন ঘটনা নজিরবিহীন। রোগে তারা ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতেন না। রোগ হলে ডাক্তার বারান্দায় বসে তথ্য নিয়ে কোনভাবে ব্যবস্থাপত্র দিতেন। যদিও বর্তমানে মামাতো ভাইরা কিছুটা আধুনিক হয়েছেন।
১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। একদিন বড় মামা আমাদের বাড়িতে এসেছেন। বাড়িতে এসে সামনের দরোজার দিকে নজর পড়লো। দরোজারা ওপর পাখি আঁকা দেখে রেগে গেলেন। মাকে বললেন, বাড়িতে ছবি থাকা হারাম। কাঠের দরোজার নকশা করা পাখির ছবি হারাম হয়ে গেলো। এখন ছবি হালাল করার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো মামাসহ কয়েকজন। তারপর মামা নিজেই একটি দা দিয়ে পাখি দুটির ঠোঁট খুচিয়ে খুচিয়ে তুলে দিলেন। ঠোঁট কেটে হালাল করে দিলেন আর কি। বর্তমানে তথাকথিত হালাল অবস্থায় আছে। এই হারাম থেকে হালাল করার দৃশ্য আমার সামনে ঘটেছে। তবে প্রাণহীন পাখি দুটি কাউকে অভিশাপ দিচ্ছে কি না জানি না।
হারাম থেকে হালাল করার এরকম অসংখ্য ঘটনা চোখ-কান খোলা রাখলে নজরে পড়বে কিংবা দেখা যাবে। এমনসব হারাম হালালের ঘটনার সঙ্গে যতোটা না ধর্ম জড়িত, তার চেয়ে বেশি জড়িত কুসংষ্কার ও বাণিজ্য। ধর্মের দোহাই দিয়ে একদল গোড়া মানুষ কুসংষ্কারাচ্ছন্ন করার জন্য এমন সব কাজ করছেন। এর থেকে আরও ভয়বহ হলো হারাম থেকে হালাল বানিয়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া। বর্তমানে কুসংস্কারের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিষয়টিও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। হাট-বাজার দোকান সর্বত্র এখন হারাম-হালাল বলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রতিযোগিতা। এটা হালাল পন্য, ওটা হারাম। কুসংষ্কার আর বাণিজ্যিক তকমা থেকে মুক্তি মেলা কঠিন।
রোগ-বালাইতে আক্রান্ত হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। সর্দি-জ¦র থেকে শুরু করে কঠিন অনেক রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য চিকিৎসকরা নানান কোম্পানীর ক্যাসুল সেবনের পরামর্শ দেন। আমরা দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য ক্যাপসুল সেবনও করি। বিশেষ পদ্ধতিতে ওই ক্যাপের ভেতর ওষুধ ভরে আটকে দেওয়া হয়। আমরা ক’জন জানি রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধের ক্যাপটি কি দিয়ে তৈরি হয়। এই ক্যাপ তৈরি হয় হাড়ের মজ্জ থেকে। এখানেও আছে হারাম-হালালের দারুন এক নাটক। জীবযন্তুর হাড় থেকে তৈরি কথিত এই হারাম ক্যাপ হালাল হয়ে যায় এক সনদে। এই সনদ না পাওয়া পর্যন্ত হালাল হবে না। তা হলে প্রশ্ন, কে দেয় এমন সনদ? শুনলে ভ্রু কুচকে যাবে।
হারাম থেকে হালালের অনন্য দৃষ্টান্ত আছে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, আমরা ক্যাপসুল আকারের যে ওষুধ খাই, তার ক্যাপটি তৈরি হয় হাড়ের একান্ত নিজ্জাস থেকে। কার কিংবা কিসের হাড় থেকে ওই ক্যাপ তৈরি হচ্ছে সেটা অনেকেই জানেন না। এতো এতা হাড় আসে কোথা থেকে? হাড় বলতে, গরু, ছাগল, মোষ, ভেরা, শুয়োরসহ সবধরণের জীবযন্তুর হাড় সংগ্রহ করে বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ক্যাপটি তৈরি হয়। হাড়গুলো অ্যাসিডে শোধন করা সহ অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে বিশুদ্ধ আকারে আমাদের কাছে আসে। তাতে কি হবে এটা তো হারাম। কারণ সংগ্রহ করা হাড়ের মধ্যে অনেকগুলোই আছে ইসলামে হারাম। তাই এটাকে হালাল করতেই হবে। ভয়ের কোন কারণ নেই, সকল হারাম হালাল হয়ে আমাদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ওষুধ নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক সনদ থাকলেও হবে না। না, কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নয়, বিশেষ কারো সনদে এটা হালাল হবে। হারাম থেকে হালাল হয় কিভাবে? কে দিচ্ছে তার সনদ? হারাম থেকে হালাল সনদ দেবেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব। হালাল সনদ নিতে হবে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের কাছ থেকে। তিনি কারখানা পরিদর্শন করে হালাল সার্টিফাইড সনদ দিয়ে থাকেন। তার দেওয়া সনদ না পাওয়া পর্যন্ত ওই ক্যাপ কিন্তু হালাল হবে না। এটা নিতান্ত সত্য ঘটনা।
আপনারা জানেন কি না জানি না। সারা দুনিয়ায় যত সাবান তৈরি হয় তার সিংহভাগ কাচামাল আসে প্রাণিজ চর্বি থেকে। বিশেষ করে শুয়োরের চর্বি এক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হয়। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ভেসজ (উদ্ভিদ) চর্বি ব্যবহার হয়। তবে সেটা ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রাণিজ চর্বিই বেশি ব্যবহার হয়। ব্যবসা সফল করার জন্য এখানেও হালাল তকমা লাগানো হচ্ছে। অনেক সাবানের গায়ে লেখা আছে হালাল সাবান। কেবল বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন একটা গোষ্ঠী। এখানেও হালাল সার্টিফায়েডের ব্যবস্থা আছে। সেই সনদ নিয়েই চলছে হারাম-হালালের লড়াই। হারাম-হালালের লড়াইয়ের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
হারাম-হালালের লড়াই দীর্ঘদিনের। এক এক সময় এক এক ফতোয়ায় হারাম হালাল বনে যায়। সেখানেও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের কোন ভূমিকা নেই। এখানেও মূখ্য ভূমিকায় ধর্মীয় নেতারা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক হারাম অজান্তেই হালাল হয়ে গেছে ও যাচ্ছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, এক সময় মাইককে বলা হতো শয়তানের বাক্স। মাইকে আজান দেওয়া হারাম। মাইকে আজান দিলে নামাজ হয় না এমন নানা ফতোয়া। যে মসজিদে মাইকে আজান হতো সেই মসজিদে অনেকে নামাজ আদায় করতো না। বর্তমানে এই হারাম যন্ত্র হালাল হয়ে গেছে। উল্টো এক ওয়াক্ত মাইকে আজান দেওয়া না গেলে নামাজের দাওয়াত দেওয়াই হয়ে ওঠে না। যারা এক সময় মাইককে হারাম বলেছিলেন, তারাই এখন বলছেন মাইক হারাম নয়। তারপর ধুয়া তোলা হলো ছবি তোলা হারাম। যারা এই ফতোয়া দিয়েছিলেন তারাই আধুনিক দুনিয়ায় যেতে এবং পবিত্র হজ্জ্ব পালনের জন্য ছবি তুলছেন। তাই এখন ফতোয়া উল্টে গেছে, এখন আর ছবি তোলা হারাম নয়। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে যা এক সময় হারাম ছিল, বর্তমানে হালাল হয়ে গেছে।
হারাম-হালালের এই দ্বন্দ্ব অনেক সময় আমাদের বিপরীত ¯্রােতের দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভিরু। কিন্তু ধর্মীয় অনেক ফতোয়া তাদের ধর্মান্ধতার দিকে ধাবিত করে। এই দ্বন্দ্ব ঘোচানো জরুরী। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে। যা কিছু ভালো সেগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে যেন কোন কুসংষ্কারের আশ্রয় নেওয়া না হয়। ধর্মকে যেন ব্যবসা হিসেবে দেখার সুযোগ করে দেওয়া না হয়। যে যার ধর্ম পালন করবে। ধর্ম দিয়ে যেন মানুষের মূল্যায়ন করা না হয়। হারাম-হালালের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।