অচলায়তান ভাঙার স্বপ্নবাজ সাথী লিটন বাশার

লিটান বাশার। পেশাদার সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকতার নেতৃত্বে এক তুর্কি সেনার নাম। বাঁধার প্রাচীর অতিক্রম করার দুঃসাহসী যোদ্ধা, অচলায়তান ভাঙার স্বপ্নবাজ মানুষ লিটন বাশার। বয়সে তরুণ হলেও প্রজ্ঞা ও সাহসে অনেক জ্যেষ্ঠর থেকে এগিয়ে ছিলেন তিনি। নিজে স্বপ্ন দেখতে জানতেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে জানতেন। তিনি তাঁর পথচলায় দৃঢ় ও নির্ভিক থেকে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে চাইতেন। তরুণ গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দীপনা ছিলেন লিটন বাশার। অগ্রজ সাংবাদিকরা স্নেহ করতেন লিটনের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান এবং কনিষ্ঠদের ¯েœহ দিয়ে অল্পদিনেই নেতৃত্বের আসনে আসীন হন লিটন বাশার। দীগন্ত ছোঁয়ার স্বপ্নবাজ লিটন বাশার বড় একটা অসময় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
লিটন বাশার দৈনিক ইত্তেফাকের বরিশাল অফিস প্রধান হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন সাংবাদিক ইউনিয়নের। এ ছাড়াও লিটন বাশার বরিশাল থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক দৈনিক বরিশাল ভোরের আলোর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। আঞ্চলিক দৈনিক দখিনের মুখের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও ছিলেন লিটন বাশার। কাজ করেছেন দৈনিক আজকের বার্তা, দৈনিক পরিবর্তন, দৈনিক বরিশাল প্রতিদিনে। বরিশালের বাইরে সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ভোলা জেলায়ও বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে লিটন বাশার সাধারণ মানুষের জন্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। একই সঙ্গে সাংবাদিকতা পেশার অসঙ্গতি দূর করতে নিবিড়ভাবে কাজ শুরু করেন।
দখলদারিত্ব এবং সিন্ডিকেট প্রথার বিরুদ্ধে লিটন বাশার ছিলেন সোচ্চার। কোন রক্তচবক্ষু লিটনের দৃঢ়তাকে টলাতে পারেনি। লড়াই করেছেন বৃহৎ শক্তির বিপরীতে থেকেও। সেই লড়াইয়ে তিনি অনেকটা লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। যখন অচলায়তন ভাঙার পর্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে, তার আগেই তাকে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিতে হয়েছে। ক্ষণজন্মা আলোকিত মানুষ, অনন্য কলম যোদ্ধা লিটন বাশার ২০১৭ সালের ২৭ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান।
সে বছর ঈদের একদিন আগে সহকর্মীদের সঙ্গে শেষ কথা বলে লিটন বাশার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান ঈদ উদযাপন করতে। ঈদের দিন রাতে বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। বিষয়টি গুরুত্ব না দেওয়ায় ঈদের দ্বিতীয় দিন সকালে ব্যাথা তীব্র হলে পরিবারের সদস্যরা তাকে বরিশালে নিয়ে আসেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডেিকল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
আজ বরিশালের সাহসী সাংবাদিক লিটন বাশারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তরুন ও মেধাবী সাংবাদিক লিটন বাশার বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষক বাবার সন্তান লিটন বাশার বরিশালের সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। তরুণ সংবাদকর্মীদের সহাস ও অনুপ্রেরণার উৎস্য ছিল লিটন বাশার। একদিকে যেমন সংবাদের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন বরিশালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অন্যদিকে সংবাদকর্মীদের সুখে-দুঃখের অন্যতম সাথীও ছিলেন তিনি। পেশাগত কাজে অনেক সাংবাদিকের আশা-ভরোসার পীঠস্থান ছিল লিটন বাশার। সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা সহকর্মীদের সমস্যায় রাজপথ এবং কলম নিয়ে একযোগে আওয়াজ তুলতেন লিটন বাশার। সকল সময় ক্ষমতাসীন দলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সহকর্মীদের নিয়ে লিটন বাশার নির্ভয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন।
শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবত বরিশাল প্রেসক্লাবের স্বার্থের প্রশ্নে লিটন বাশারের ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। অপেক্ষাকৃত নবীন হয়েও সাংবাদিক নেতৃত্বে তাঁর পেশাদারিত্বের ছাপ ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকের চেয়ে নবীন লিটন বাশার প্রেসক্লাবে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে তাক লাগিয়ে দেন। এর মাধ্যমে লিটন বাশার সংবাদকর্মীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেন। কনিষ্ঠদের যেমন স্নেহ করতেন, তেমনি জ্যেষ্ঠদের সম্মান দিয়ে আস্থাভাজন হয়েছেন। লিটন বাশার বরিশাল প্রেসক্লাবের নেতৃত্বে নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। সঙ্গীতপ্রিয় লিটন বাশার গান শুনতে পছন্দ করতেন। তাঁর অনেক লেখায় রবীন্দ্রানাথের গানের উদ্বৃতি পাওয়া যেত। পাওয়া যেত কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন শিল্পীর গানের কথা। সাংবাদিকতার পাশপাশি তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করেছেন। যদিও সেটা প্রচ্ছন্নভাবে করা হয়নি। তবে সহযোগী হয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে।
আজ লিটন বাশারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। লিটন বাশার আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। কিন্তু আমাদের লিটন বাশারের মত দৃঢ় সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতার খুব বেশি প্রয়োজন। আজকের এই দিনে লিটন বাশারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। একই সঙ্গে লিটন বাশারের একান্ত স্বজন শিশুপুত্র, স্ত্রী, বাবা-মা ভাই-বোনের প্রতি সমবেদনা জানাই।
কালিকা প্রসাদের লেখা ও গাওয়া কয়েকটি লাইন দিয়ে প্রয়াত লিটন বাশারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করছি-
‘আমি তোমারই, তোমারই, তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি।
আমি আকাশে রোদের দেশে ভেসে ভেসে বেড়াই
মেঘের পাহাড়ে চড়ো তুমি।
তুমি এসো ফসলের ডাকে বটের ঝুরির ফাঁকে
আর এসো স্বপ্ন ঘুমে
এই স্বপ্ন দু’চোখ খুলে জেগে দেখা যায়
যদি নয়ন তারায় বসো তুমি
কবিতা গেল মিছিলে, মিছিল নিয়েছে চিলে
অসহায় জন্মভূমি
আজ একতারার ছিলা তোমার স্পর্শ চায়
যদি টঙ্কার দেও তুমি’