অজ্ঞতায় করোনা থামানো যাবে না
শক্তির অপার দম্ভ। জ্ঞান বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব নিরন্তর বিকাশ, আধুনিকতার সীমাহীন উৎকর্ষ সাধন, নান্দনিকতার চরম তাত্ত্বিক সমস্ত রূপকল্পগুলো নানান ধর্মের বর্ণময় বিশ্লেষণকে স্থির, স্তব্ধ ও স্থবির করে দিয়ে মুহূর্তেই অন্ধকার এক অবিশ্বাস্য পথে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের, ‘করোনা’। এক ভাইরাস যার প্রতিশেধক অনাবিষ্কৃত। আপাতত জন্মস্থান চীনের উহান প্রদেশ। এখন পর্যন্ত নিজের রূপ পরিবর্তন করেছে ১৪৯ বার। এই করোনার ব্যাপ্তি এবং সতস্ফূর্ত প্রসার এখন প্রায় পৃথিবীর সর্বত্র। চিকিৎসা বিজ্ঞান এর সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত খুব ভালো কিছু বলছে না। শুধু মাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর হাত ধোয়ার ব্যবস্থাপত্র দিয়েই চুপ করে আছে। কোন প্রতিকার আবিষ্কারের স্বচ্ছতা পৃথিবীর হাতে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে নেই।
গুজব আছে ভারত পেরেছে, জাপান, ইজরাইল পেরেছে, চায়না পেরেছে, পেরেছে আমেরিকাও এর প্রতিশেধক তৈরি করতে। তবে তা এখনো গল্পই। এই মুহূর্তে আমেরিকার কোন কোন প্রদেশে করোনার প্রভাবে চলছে কারফিউ। ইতালি ও ফ্রান্স সামরিক বাহীনি নামিয়াছে রাস্তায়। এখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যারা কেবল নিজেদেরকেই মানুষ ভাবে তারা সবাই এখন মূলত ঘরে ঘরে আবদ্ধ। জনশুন্য, যানশুন্য রাস্তা। পৃথিবীর অনেক উন্নত শহর যারা কোনদিন গতিপথ হারায়নি সেই সব জায়গা এখন বিখ্যাত সব হরর ছবির বাস্তব রূপ লাভ করেছে। সকল কিছু থামিয়ে দেওয়া হয়েছে করোনা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে। কেবল আমরা পারিনি। এই আমরা এতোই অদ্ভুত, কখন কি পারি আর পারি না সেটাও ঠিক বুঝতে পারি না।
তবে যা বুঝি তার থেকে অনেক অনেক বেশি বলতে পারি। সেটা আমিসহ সবাই। যদিও এ সত্য এখন পৃথিবীর সর্বত্র। কারণ পৃথিবী এখন মূলত ধারাবাহিক অনুশিলনে মত্ত। কোন ব্যতিক্রম কারো পছন্দ নয়। এই করোনা নিয়ে প্রথম চায়নায় যে ডাক্তার কথা বলেছিলেন, যার মৃত্যুর কারণও এই করোনা। তিনিই প্রথম বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন এর ভয়াবহতা ও ব্যপকতা। পারেননি। দারুনভাবে নিগৃহিত হয়েছেন তার নিজের রাষ্ট্র প্রশাসন এবং পুলিশ দ্বারা। তাতে তার সত্যের কি মৃত্যু হয়েছে? করোনা কি এখন পৃথিবীজুড়েই প্রতিষ্ঠিত এক সত্যের নাম নয়, এক ভীতির নাম নয়, এক আশংকার নাম নয়? বিশ^ মানবতার গতি রুদ্ধ করা এক ভয়াল দানবের নাম নয়? প্রথম সত্য উচ্চারণের বড় দায় বড় কষ্ট। প্রথম প্রতিবাদের বড় ঝক্কি। প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দিলে রক্তচক্ষুর জ¦ালা সইতে হয়। তাই এখন আর কেউ পারতপক্ষে সে পথ মাড়ায় না। আহা বেশ বেশ এই ভালা এই ভালো করেই এখন সবাই সময় কাটাই। এই ভালো, ভুল না ধরলে আর কিসের ভুল? যদিও এ জাতীয় মানুষদেরও একটাই ভুল। তারা কখনোই প্রথম প্রতিবাদী হয় না কিংবা পারে না। কিন্তু প্রতিবাদে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের সরব উপস্থিতি ঘোষণা করতে চরম হ্যংলামিতে মত্ত হন।
এখন আমাদের হাঁচিতে ভয়, কাশিতে ভয়, হঠাৎ গরম ঠান্ডায় শ্বাসকষ্টে ভয়। কারণ একটাই করোনা। অথচ প্রতি ঋতু পরিবর্তনে আমাদের দেশে এই রোগ হওয়া অতি স্বাভাবিক, অতি পরিচিত, নিরাময়যোগ্য। কিন্তু করোনা? মোটেই তা নয়। সে ভয়াল, প্রতি মুহূর্তে পাল্টাচ্ছে নিজ রূপ। ইতিমধ্যে এর মৃত্যুহার দ্রুত বিশে^র দেশে দেশে ছড়িয়ে পরায় জাতিসংঘ একে মহামরি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আজ আর মনে হচ্ছে না পৃথিবীর কোথাও কোন শক্তির অস্তিত্ব আছে। কোন কামান গোলা মিজাইল, কোন বোমারু যুদ্ধ বিমান, কোন টর্পেডোবাহি রণতরী। না, কারোই এখন কোন শক্তি নেই। এই পৃথিবীতে যে যত বড় শক্তিধর ছিলো এতদিন, এখন সে তত বেশি থরকম্পমান। এখন সব বন্ধ। সীমান্ত যুদ্ধ বন্ধ। হিংসার রাজনীতি বন্ধ। ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদ বন্ধ। সবাই নতজানু করোনার কাছে। আজ করোনা যদি বলে সমগ্র পৃথিবীবাসিকে ‘এসো আমার সামনে করজোড় মাথা নিচু করে বলো, তোমরা পরাজিত’। তবে তাই হবে। কোথাও কোন কথা হবে না বিশ^বাসী বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে করোনার এই শর্ত।
এ আমি শুধু কথার কথা বললাম মাত্র। না, পৃথিবীর জীবনিশক্তিকে ম্লান হতে দেবে না মানুষ। শ্রষ্ঠার দেওয়া শ্রেষ্ঠত্ব সে হারাবে না কখনো কারো কাছে। এ সাময়িক, ঘুরে সে দাঁড়াবেই। অবাক এই পৃথিবীর সকল অর্জন এবং আবিষ্কার সে তো মানুষের হাত ধরেই। যদিও পৃথিবীর তাবদ জঞ্জাল, কূট, এবং সকল অশুভ কর্ম হয়তো করোনাও কোন মানুষেরই কর্মফল! তবু ধৈর্য আমাদের। স্থিরতা আমাদের। প্রজ্ঞা আমাদের তাকেও বিনাশ করবেই। আজ করোনা ছুটছে মানুষের পিছনে। মানুষ পথ খুঁজছে বাঁচার। কাল মানুষ ছুটবে করোনার পিছনে, করোনা পথ পাবে না বাঁচার। সেও পরাস্ত হবে। ম্যলেরিয়া, বসন্ত, ডায়রিয়া, জিকা, ইবোলা, এনত্রাক্স, বার্ডস ফ্লু, প্লেগ, ডেঙ্গুর মত করে। শধু অপেক্ষা সময়ের। তবে সেটা সময় করে ভোর রাতের অন্ধকারে ফরজ ফজরের নামাজ বাদ দিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে গাছের সমস্ত কাঠাল পাতা চিবুলে হবে না। তা হলে সকাল বেলায় ছাগলের খাদ্য সংকট দেখা দিবে।
এখন সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে হবে পৃথিবীকে। তার সিদ্ধান্তকে। তাদের করোনা নিধন সংক্রান্ত দিক নির্দেশনাকে। যে সিদ্ধান্তের অন্যতম হলো হাত মুখ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মানুষকে মানুষ থেকে আপাতত দূরে থাকতে হবে। ভীড় এড়িয়ে চলতে হবে। হোক সে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রের। তা না হলে বিপর্যয় অবধারিত। এখানে আবেগের, অজ্ঞতার কোন জায়গা নেই। এখানে থানকুনি পাতা, কিংবা কাঠাল পাতা কিংবা স্বপ্নে প্রদত্ত পানি পড়া অথবা চরণামৃত কিংবা মন্দিরের ভোগ বা গো-চোনা কোন কাজেই আসবে না। এখন সময় নয় অজ্ঞতার আঘাতে করোনা থামানো। এখন প্রয়োজন যোগ্যতার আঘাত। যা দেখছি তাকে বিশ্বাসে নিতে হবে যা শুনছি তার বিচক্ষণ অংশ অনুশীলনে ব্যস্ত হতে হবে। মনে রাখা খুবই জরুরী, এখন মানুষের জন্য ধর্মের প্রয়োজন থেকেও এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ধর্মের জন্য মানুষের। মানুষ সুস্থ্য সবলভাবে বেঁচে থাকলে তবেই ধর্মের যথার্থ বিস্তার ঘটবে। মানুষ থাকলেই আবার মসজিদ মন্দির গীর্জা ভরে উঠবে পবিত্র ধর্ম অনুশীলনে। এখন ধর্ম বিশ্লেষণের সময় নয়। এখন অতি জরুরী প্রাণের প্রয়োজনে দরকার চিকিৎসা বিজ্ঞানের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অনুসরণ।
জানি না বাংলাদেশ এবং আমরা এ বিষয়ে এখন কতটা প্রস্তুত এই সময়ে? কতো টেষ্ট কিটস্ আছে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান প্রয়োজনে। আদৌ আছে কি? ডাক্তার নিরাপত্তার বিষয়টি কে ভাবছে? কিভাবে? এই প্রথম আমাদের দেশের ডাক্তাররা পেশা এবং সেবার মূল রূপ দেখতে পারবে। পারবে উপলব্ধি করতে। কঠিন এই সময়ে আমাদের সবার জন্য। এখন পর্যন্ত যা প্রস্তুতি তা শুধুমাত্র মুখের বুলি। এখন সকল আলোচনাগুলোকে অতি দ্রুতই আস্থায় নেওয়া দরকার। এখনই যদি কঠিন কঠোর হওয়া না যায়, তবে এ গজবের হাত থেকে মুক্তি পাবে না কোন আস্তিক, নাস্তিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার, শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতির কেউ। চীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। সে আশ্বাস কি পূর্ণ হবে মানুষের মৃত্যুর মিছিল শুরুর পূর্বে? না, চীন বা আমেরিকার আশ্বাস পৃথিবীর কোথাও কোনদিন কোন মানুষের প্রাণ বাঁচায়নি, বাংলাদেশে তো নয়ই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ তারই সাক্ষি দেয়। মিয়ানমার, বাংলাদেশ, রোহিঙ্গা বিষয়ে তাদের আশ্বাস একই রকম অর্থহীন।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সকল সামজিক অনুষ্ঠান, বাজার ঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয় কোর্ট কাচারি এবং সকল গণপরিবহনে মানুষের অবাধ বিচরণ থামিয়ে দেওয়া। যেটুকো না করলে নয় বিশেষ পেশাদারদের যথাযথ প্রতিরোধক উপকরণ সরবরাহ করা। এটিই এখন মূল অস্ত্র করোনা যুদ্ধের। আমরা এখনো সেটা পারছি না। ডাক্তারদের হাতে এখনো পৌঁছায়নি যথার্থ উপকরণ। কোথাও কোন ব্যবস্থাপনার যথার্থতা নেই মুখের কথায় ছাড়া। এখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই আস্থায় রাখতে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী এম.পিরা। এই যুদ্ধে সত্য উপলব্ধির ব্যর্থতা জাতিকে চরম মূল্যের মুখোমুখি করে তুলতে পারে।
আমরা যেন ভুলে না যাই মুুজিব জন্ম শতবর্ষের শুরুতে যে আতসবাজি বিকট শব্দে রং ছড়িয়েছে সমগ্র দেশময়। তার সেই রঙিন আভাস যেন অবিস্মরণীয় করে রাখতে পারি আমাদের এই করোনাবিরোধী যুদ্ধে, সকল কর্মের সততায়, যোগ্যতায়। করোনা যুদ্ধ জয়ের কোন প্রস্তুতি গ্রহণের পুর্বেই আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি নিজ নিজ খাদ্য সংগ্রহে। এ আশংকা আমাদের চিরদিনের। কারণ আমরা সকলেই দেশের কোন বির্পযস্ত পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। এই নিরাপত্তাহীনতা আমাদের আরো বিপর্যস্ত করে তুলবে অচিরেই। কোয়ারেন্টাইন নিয়ে আর কালক্ষেপণের সুযোগ বা সময় এখন আর আছে বলে মনে হয় না। সে ভুল হয়েই গেছে। এখন চিরদিনের নোংড়া পচা অন্তসার শুন্য কথা বলাবলিকে পিছনে ফেলে যথার্থ যোগ্যতায়, কঠোরতায়, আমরা সবাই অভিন্ন সহমর্মিতায় করোনার বিরুদ্ধে দাঁড়াই। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ আমাদের সহায় হবেন। আমরা অতিক্রম করতে পারবো এই ভয়াল পথ, মানব সভ্যতার উপর এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ আঘাত করোনাকে, ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশে মুজিব জন্ম শতবর্ষে মহান আল্লাহ যেন আমাদের সেই নেয়ামত দান করেন। আমার এই পৃথীবির মুক্ত মানুষ যেন এক সাথে অতি দ্রুতই গাইতে পারি ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাশে। শাখে শাখে পাখি ডাকে, কতো শোভা চারিপাশে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’।