অশ্বিনী কুমার ও সরকারি বরিশাল কলেজ

অশ্বিনী কুমার ও সরকারি বরিশাল কলেজ

কে অশ্বিনী কুমার? কিভাবে তিনি মহাত্মা হলেন? কোথায় অশ্বিনী দত্তের বাড়ি? সরকারি বরিশাল কলেজের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের সম্পর্ক কি? কেন বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে অশ্বিনী কুমারের নামে করার প্রস্তাব উঠলো? এসব প্রশ্নের উত্তর ১৯০০ সাল থেকে ১৯৭০ সালের সমসাময়িক মানুষদের জানা। স্বাধীনতার পরও যারা আমাদের সামজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক তাদের কাছেও বিষয়টি স্বচ্ছ। ১৯৯০ পরবর্তী কিংবা তার পরের প্রজন্মের কাছে অশ্বিনী দত্ত এবং তার বাস ভবনের ইতিহাস ফিকে হতে শুরু করে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে অস্তিত্ব কেবল একটি নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। নতুন প্রজন্ম সরকারি বরিশাল কলেজ চেনে এবং জানে। জানে না এর সঙ্গে অশ্বিনী কুমার দত্তের সম্পর্ক কি। তাই বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে অশ্বিনী কুমারের নামে নামকরণের প্রস্তাব শুনে তাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে। বলতে পারেন প্রশ্নটি এই প্রজন্মের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের প্রশ্ন বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে নয়। যারা ৭০ কিংবা ৮০ দশকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাড়িতে নির্মিত বরিশাল কলেজের ছাত্র ছিলেন তাদের বর্তমান ভূমিকা নিয়ে। এক সময় সাবেক এই ছাত্ররাই বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে অশ্বিনী কুমারের নামে করার জন্য দাবি তুলেছেন, আন্দোলন করেছেন। সেই সাবেক ছাত্ররাই আবার অশ্বিনীকুমারের নামে নামকরণ হতে যাওয়ার সময় বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। যে সাবেক ছাত্ররা করোনা দুর্যোগের ভয়ে ঘর থেকে বের হননি। তারা হঠাৎ অশ্বিনী বিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে কেন? কারা এবং কি স্বার্থে এদের উসকে দিলো। করোনার ভয়ে অন্তরীণ এসব ছাত্ররা হঠাৎ কি করোনা জয় করে ফেললেন? কোন রকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই তারা সদর রোডে সরকরি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন না করার পক্ষে নামলেন। এর যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কেউ কেউ অবশ্য বলবার চেষ্টা করছেন বরিশাল নাম যুক্ত আছে সেখানে অন্য নাম কেন। বরিশাল সরকারি অশ্বিনী কুমার কলেজ নামকরণ হলে কি বরিশালের নাম মুছে যায়? যায় না। যারা বরিশালকে ভালোবাসেন তারা অশ্বিনী কুমারকেও ভালোবাসেন। শ্রদ্ধা করেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা শুনেছি সবাইকে না জানিয়ে নাকি সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। খুব ভালো কথা, এবার তো সবাই জেনেছেন। প্রয়োজন হলে আরো বৈঠক করে সবাইকে জানিয়েই অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করা হোক। এব্যাপারে বোধকরি কেউ আপত্তি করবে না।

কিন্তু যখন অশ্বিনী কুমারের নামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একজন চিহ্নিত ব্যক্তির নাম উঠে আসে। তখন হতবাক হই। তখন মনে হয় বরিশাল কলেজের নাম অপরিবর্তিত রাখার না রাখার বিষয় নয়, একটা সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে লালন করার অশুভ উদ্যোগ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বরিশালকে সাম্প্রদায়িক আবহের দিকে নিয়ে যাওয়ার দূরভিসন্ধি। যারা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত কিংবা ৭৫-এর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একজনের নাম মেলাতে চান। তাদের উদ্দেশ্য আর যাই হোক মহৎ হতে পারে না। আমাদের সংকীর্ণ চিন্তার উর্ধে উঠে ভাবতে হবে। বরিশালের আবেগ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে নয়, বরিশালের সঙ্গে যুক্ত করার যে উদ্যোগ সেই উদ্যোগ যেন কোনভাবেই ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া না হয়।

আমরা লক্ষ্য করলাম গত শনিবার সরকারি বরিশাল কলেজের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের ব্যানারে কিছু শিক্ষার্থী একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে দাবি তোলেন। সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের ব্যানারে হলেও আন্দোলনে সক্রিয় দেখা গেছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। তার সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরসহ আরো কয়েক নেতা এবং জেলা যুবদলের দুইএক নেতাকে দেখা গেছে। অথচ আওয়ামী লীগ সব সময় অশ্বিনী দত্তের নামে বরিশাল কলেজের নামকরণের পক্ষেই ছিল এবং এখনও আছেই মনে করি।

আন্দোলনকারী নেতারা পরবর্তী সময় বরিশাল শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানকে নাম পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থা না নেওয়ার জন্য বলেনে। একই দাবিতে তারা তার কাছে একটি স্মরকলিপি দেন। এছাড়া জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কলেজের নাম পরিবর্তন না করার জন্যও স্মারকলিপিও দিয়েছেন। অথচ যারা আজ এই দাবির পক্ষে নেমেছেন, তারাই কিন্তু একদিন অশ্বিনী কুমারের নামে নাম পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অর্থাৎ ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের সাংসদ অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস জাতীয় সংসদেও বরিশালবাসীর পক্ষে অশ্বিনী কুমারের নামে কলেজের নাম পরিবর্তনের দাবি তোলেন। ওই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আস্তে আস্তে দাবি আরো জোরদার হয়।

বরিশালের জেলা প্রশাসক গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। গত ২৯ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডকে সরকারি বরিশাল কলেজকে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ নামকরণের যৌক্তিকতা উল্লেখ করে সুপারিশ প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে। শুরু হয় অশ্বিনী দত্তের নামে নামকরণের প্রাথমিক কাজ। সেই কাজের মাঝখানে গোলবাধানোর কোন কারণ থাকতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।

বর্তমান বরিশাল কলেজ এবং অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের ইতিহাস তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক। ১৯২৩ সালে অশ্বিনী কুমার দত্তের মৃত্যু হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁর একমাত্র ভাতিজা সরল দত্ত দেশত্যাগ করলে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনটি বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ‘অশ্বিনী কুমার কসমোপলিটন (সব ধর্মের ছাত্রদের জন্য) ছাত্রাবাস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৬২ সালে কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহযোগিতায় অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করা হয় নৈশ কলেজ। স্বাধীনতার পরে কলেজটি অশ্বিনী কুমারের নামে করার দাবি উঠলেও নামকরণ করা হয় বরিশাল কলেজ নামে।

বরিশালের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তি আইনজীবী ও সাংবাদিক এসএম ইকবাল জানান, ১৯২৩ সালে অশ্বিনী কুমার দত্তের মৃত্যু হয়। ১৯৫৫ সালে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনটি বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ‘অশ্বিনী কুমার কসমোপলিটন ছাত্রাবাস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই ছাত্রাবাসে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদসহ বর্তমানের অনেক আওয়ামী লীগ নেতারা এখানে ছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি। ১৯৬২ সালে এখানে গড়ে তোলা হয় বরিশাল নৈশ কলেজ। স্বাধীনতার পর কলেজটি অশ্বিনী কুমারের নামে নামকরণের দাবি উঠলেও সে দাবি পূরণ হয়নি। অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনে বর্তমান সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নামে করলে এমন কোন ক্ষতি নেই। এই দাবির পক্ষে বরিশালের সর্বস্তরের মানুষ ছিল। এখন যারা আন্দোলনে নেমেছে তাদের মধ্যে অনেকেই অশি^নী কুমারের নামে নামকরণের পক্ষেই ছিলেন। কি কারণে তারা এর বিরোধীতা করছেন জানি না। সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করা উচিত।

যারা বরিশালের আবেগের সঙ্গে থাকার দোহাই দিয়ে অশ্বিনী কুমারের নামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের প্রতি আহ্বান, বরিশালের সঙ্গে আপনাদের যেমন আবেগ তেমনি বরিশালের সাধারণ মানুষের আবেগও কোন অংশে কম নেই। তার চেয়েও বেশি যার ছিল তিনি হচ্ছেন অবহেলিত দক্ষিণ জনপদের শিক্ষার রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত। ৬৫ একর জমির ওপর নির্মাণ করে গেছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ব্রজমোহন কলেজ, করেছেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। তাঁর নিজের বাড়িতে নির্মিত বরিশাল কলেজের সঙ্গে কেন তার নাম থাকতে পারে না একবার ভাবুন।

আসুন, আমরা সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে প্রাধান্য না দিয়ে সামনে হাঁটি। এই মুহূর্তে যারা সরকারি বরিশাল কলেজের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যেতে চান, তাদের অশুভ চিন্তা দূর করে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার আহ্বান জানাবো। একটা সুন্দর কাজের সঙ্গে থেকে কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাই। সবাই মিলে মহাত্মা অশি^নী কুমার দত্তের বাসভবনে নির্মিত বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নামে করার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানাই।