অসাম্প্রদায়িক নজরুল ও আমাদের বোধ

‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান
গাহি সাম্যের গান।’
বিশ্বের বিভিন্ন অংশে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মীয় উগ্রতা, ধর্মের দোহাই দিয়ে অরাজকতা, ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র হিংসা-বিদ্বেষ যে পর্যায়ে পৌছেছে তা থেকে উত্তোরণের উপায় যে বাঙালি কবি তাঁর সাহিত্য কর্ম দিয়ে সর্বোচ্চভাবে বলে দিয়েছেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল জীবনে ও মননে অসাম্প্রদায়িকতার ধারক, বাহক ও প্রচারক ছিলেন। তাঁর ভিতরে যে বাণী মজ্জাগত হয়েছিল তা হলো ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ যে দৃঢ় উচ্চারণে তিনি অবিস্মরণীয় সেটি হলো- ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।’
পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতায় ক্ষুব্ধতা
নজরুল ধর্মীয় সাম্যতার দর্শনকে ব্যক্তিজীবন ও ঘরেই বাস্তবায়ন করেছিলেন নির্দ্বিধায়। তিনি তাঁর চার সন্তানের নাম রেখেছিলেন- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। তিনি একদিকে যেমন ইসলামী ভাবধারার গজল গান লিখেছেন তেমনি আবার শ্যামা সঙ্গীতও লিখেছেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।” এই গান ছাড়া বাঙালীদের ঈদ উৎসব প্রায় অসম্পূর্ণ।
বাংলার সাহিত্যাকাশে নক্ষত্ররূপে প্রথাগত শৃঙ্খল, কুসংস্কার, অসাম্য নীতি, বর্ণ বৈষম্য, জাতিগত বিরোধ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেওয়ার সুবৃহৎ হাতিয়ার হয়ে ওঠেন নজরুল। তাইতো ‘হিন্দু মুসলমান’ কবিতায় লিখেছেন-
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
কবি তাঁর কলম দিয়ে যুদ্ধ করেন। কলমই হয় তার শাণিত অস্ত্র। নজরুল তাঁর সেই অস্ত্র ব্যবহার করে ‘ঈশ্বর’ কবিতায় লিখেছেন-
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড় চূড়ে
হায় ঋষি-দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধরে তারে খোজ তুমি দেশ দেশ।’
তিনি ‘মানুষ’ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন-
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
নজরুল ধর্মের দেয়ালে মানবতাকে সীমাবদ্ধ হয়ে ডুকরে কাঁদতে দেখেছেন। হৃদয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ‘হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতার লাইনে লিখেছেন-
সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুড়া!
প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ
চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।’
১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ থেকে নজরুল বাংলাদেশী নাগরিক। যদিও ১৯৭৬ সালে নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করার মাধ্যমে তাঁকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। দ্রোহের কবি নজরুল মারাত্মক স্নায়বিক অসুস্থতায় (পিক্স ডিজিজ) মৃত্যু পর্যন্ত মোট ৩৪ বছর সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে বাংলা সাহিত্যকে তিনি যে সমৃদ্ধির উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে গেছেন তা তুলনারহিত। বাঙালীর মানসপীঠে যে অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন ছড়িয়ে গেছেন, তা যুগ থেকে যুগান্তরে, শত থেকে সহস্র বছরে প্রাসঙ্গিক। তাঁর লেখা-
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ, নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই।
নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ, শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুঃখের সিংহাসন।’
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে নজরুলের আলোচনা উঠতেই সেই টেবিলে আমরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে টেনে নিয়ে এসে নড়েচড়ে বসি। সাম্প্রদায়িক যাতাঁকলে রবীন্দ্রনাথকে পিষে দিয়ে নজরুলকে নিয়ে আমরা পৈশাচিক আনন্দে মাতি। অর্থাৎ, কিছু ক্ষেত্রে আমরা উদ্দেশ্য নিয়েই নজরুল প্রেমে মজে উঠি রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠার জন্য। কি অদ্ভুত! অথচ আমরা নজরুলের উর্দির নিচে শক্ত ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে তলিয়ে দেখার মগজ রাখি না। অথবা বুঝতে পারলেও আত্মতৃপ্তি পাওয়ার জন্য ওটাকে সচেতনভাবে আড়াল করি। আসলেই কি এহেন ব্যবচ্ছেদে রবীন্দ্র-নজরুলের কিছু যায় আসে? এমন উঁচু নিচুর টানা হেচড়ায় তাদের অর্জিত স্থান থেকে আদৌ কি তাদের নড়ানো যায়?
লেখক: পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাষক, ইংরেজী বিভাগ, মানিক মিয়া মহিলা কলেজ, বরিশাল