উদীচী-বনার বসন্ত উৎসব

বসন্ত উৎসব উৎসর্গ করা হয় সংস্কৃতিজন সাহান আরা বেগম, মুক্তিযোদ্ধা শেখ কুতুব উদ্দীন আহম্মেদ, সংগীত শিল্পী এমএ জলিলকে
গতকাল রোববার ছিল ফালগুনের প্রথম দিন। একই সঙ্গে ভালোবাসা দিবসও। প্রিয়জনকে ভালোবাসা জানানো, বাসন্তি সাজে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত শিশু, নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ। করোনাকে পাত্তা না দিয়ে মানুষের ঢল নামে উদীচ ও বরিশাল নাটকের বসন্ত উৎসবে। উৎসবপ্রিয় বাঙালি মিলিত হয় এক সমোহনায়। সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় করোনামুক্ত রঙিন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।
করানা মহামারীকে উপেক্ষা করে উদীচী ও বরিশাল নাটকের আয়োজনে অনুষ্ঠিত জগদীশ সাস্বরত বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গনে মানুষের ঢল নামে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্ষিপ্ত আয়োজন আর সংক্ষিপ্ত রাখা সম্ভব হয়নি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘করোনার কথা ভুলে গিয়ে মানুষ প্রাণের উৎসবে মিলিত হয়েছে। এটা কতটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলবে আমার জানা নেই। তবে বাঙালি যে উৎসবপ্রিয় তার প্রমাণ মিলেছে উদীচী ও বরিশাল নাটকের বসন্ত উৎসবে।’ তিনি নগরবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং করোনার টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘প্রায় এক বছর মানুষ গৃহবন্দী থাকার পর আজকের তারা বেরিয়ে এসছে। এইভাবে একত্রিত হয়ে আমরা করোনামুক্ত পরিবেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চাই। আমরা অবশ্যই করোনাকে জয় করার পথে হাঁটছি। সবাই মিলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। তার মধ্য দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
বিকেল সাড়ে চারটায় মঞ্চে বেজে ওঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে, ওগো আমার প্রিয় তোমার রঙিন উত্তরীয়...’ রবীন্দ্রনাথের এই গান। সঙ্গে সঙ্গে উদীচী এবং বরিশাল নাটকের কর্মীরা ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় আগত অতিথি, দর্শক-শ্রোতাদের।
‘বাসন্তি বিকেলে এসো স্নাত হব আনন্দ ধারায়’ শিরোনামে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এবং বরিশাল নাটক। করোনার কারণে এবারের আয়োজন সীমিত করা হয়। তিনদিনের মেলা বাদ দিয়ে কেবল একদিনের উৎসবের আয়োজন করা হয়।
বসন্ত উৎসব উপলক্ষে সারস্বত বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বাসন্তি রঙে সাজানো মঞ্চ নান্দনিক মঞ্চ সজ্জার আর বসন্ত উৎসবের বর্ণিল আয়োজনে একাকার হয়ে যায় নগরবাসী। একটা সময় পুরো মাঠ জুড়ে কেবল হলুদের ছাড়াছড়ি চোখে পড়ে।
ব্যতিক্রমী আয়োজনে ছিল না কোন সভাপতি। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যালের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে দর্শকদের শুভেচ্ছা জানান।
এবারের বসন্ত উৎসবে ব্যতিক্রম ছিল গত কয়েক মাসে সাংস্কৃতিক, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যারা প্রায়ত হয়েছেন। যাঁদের স্পর্শে মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক অঙ্গন রাজনী সমৃদ্ধ হয়েছে। এমন তিন প্রয়াতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা। এদের মধ্যে অন্যতম বরিশালের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও রাজনীতিক সাহান আরা বেগম। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরিশাল জেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার শেখ কুতুব উদ্দীন আহম্মেদ। আর অন্যজন প্রতি বছর বসন্ত উৎসবে দর্শকদের গান গেযে মাতিয়ে রাখতেন সুরলহরী সঙ্গীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানা সংগীত শিল্পী এমএ জলিল। অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে এই তিন গুণি ব্যক্তিত্বের তিনটি ছবি রেখে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে শুরু হয় বসন্তের অনুষ্ঠান।
সভাপতি বর্জিত বসন্তের প্রথমদিন নাগরিকদের শুভেচ্ছা জনিয়ে কথা বলেন, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার, মুক্তিযোদ্ধা কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক (বীরপ্রতীক), শিশু সংগঠক জীবন কৃষ্ণ দে, ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া, শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক আল-আমিন সরোয়ার, বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা, খেলাঘর বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক নজমুল হোসেন আকাশ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি অ্যাড. গোলাম মাসউদ বাবলু, সরকারি বরিশাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্বাস উদ্দিন খান, উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. নাছিরউদ্দিন, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শুভাষ চন্দ্র পাল, ডিডাব্লিউএফ নার্সিং কলেজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জহিরুল ইসলাম, উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি অ্যাড. বিশ্বনাথ দাস মুনশী, বাংলাদেশ বেতার বরিশাল কেন্দ্রে আঞ্চলিক পরিচালক কিশোর রঞ্জন মল্লিক, বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য ও বরিশাল নাটকের সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন লাবু, জগদীশ সারস্বত বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আসাদুল আলম, বরিশাল নাটক সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী, উদীচীর সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণ, সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংশু বিশ্বাস।
আবৃত্তি, সঙ্গীত, নৃত্য-কথামালায় পুরো অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বসন্ত উৎসবের বর্ণিল আয়োজনে গান, আবৃত্তি, নৃত্যের ফাঁকে ফঁকে পর্যায়ক্রমে শুভেচ্ছা।
উদীচী শিল্পীকর্মীদের শুচনা সঙ্গীতের পর বরিশাল নাটক পরিচালিত আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিশুরা আবৃত্তি পরিবেশন করে। এরপর আবৃত্তি পরিবেশন করে কবিতার ক্লাশ আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা। সঙ্গীত পরিবেশন করে উত্তরণ সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরলহরী সঙ্গীত বিদ্যালয়, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ। একক সঙ্গীত পরিবেশন করে জহিরউদ্দিন সরদার জিল্লু, শেখ নাসের জামাল, মিঠুন রায়, কমল ঘোষ, মুনিয়ার রহমান রচি। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যাঙ্গন নৃত্য একাডেমি, খেলাঘার এবং শফিক ব্যালে ট্রুফ।
এদিকে বসন্তকে বরণ করতে সার্কিট হাউস চত্বরে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত বসন্ত উৎসব। সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বিভাগীয় কমিশনার ড. অমিতাভ সরকার, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই আয়োজনেও গান, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।