এই ঈদে কোলাকোলি হবে ইশারায়

এই ঈদে কোলাকোলি হবে ইশারায়

ধর্ম ও বিধান বলে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কোরবানী করো আপনজন। যুগের পরিবর্তিত ধারা এবং বাস্তবতা বলছে, সময়ের বিধান হলো পশু কোরবানী করো। স্রষ্টা অন্তর্যামী বলেই বুঝতে পেরেছিল, এমনটা না করলে এ ধর্মের অনুশীলন কঠিন হয়ে পরবে। নির্দিষ্ট এক ধর্মের মানুষ ক্রমশ নাই হয়ে যাবে। স্রোষ্টা জানে সমন্বয় করতে। তাই তার নির্দেশেই হয়তো সৃষ্টি হলো ধর্মের বিভিন্ন ধারা। কারো কাছে কোন কোন পশু খাদ্য সম আবার কারো কাছে সেটাই আবার ধর্ম অনুশীলনের অনুসঙ্গ, প্রণম্য, পূজনীয়। ধর্ম বলে কথা। তার বাইরে যাবার সুযোগ কোথায়? সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে পশু হত্যা। কেউ কেউ বলতে চায় কোরবানী এবং হত্যা এক শব্দ নয়, অর্থও এক নয়। কোরবানীর সঙ্গে মহিমার একটা যোগসূত্র থাকে। হত্যায় তেমনটা থাকার সুযোগ থাকে না। হয়তো থাকে, হয়তো নয়। সে যেটাই হোক, এখানে খুব সহজ একটা প্রশ্ন হলো পশুটা কি বেঁচে থাকে?

যদি বলি বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে করোনার কোরবানী কিংবা হত্যা মানুষ। এই শব্দ-অর্থ দ্বন্দ্বে মানুষ কি বেঁচে থাকে। এই করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চল্লিশ লাখ। এই সংখ্যার শেষ কোথায় কেউ জানে না সে কথা। প্রতিদিন কান্নার শব্দে ভারী হচ্ছে বাতাস। প্রতিদিন মসজিদের মাইকে মৃত্যু ও জানাজার ঘোষণা। শ্মশান পুরীতেও লাশের মিছিল। কোন জায়গায় সৎকারকর্ম সঠিকভাবে সম্পাদন করা যাচ্ছে না সবার। ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাশ গঙ্গায়, যমুনায়। পৃথিবীর সর্বত্র এবং সকল শ্মশান গোরস্থানের দৃশ্য একই। তবু সচেতনতা নয়। সবাই করোনা থেকে বাঁচতে দিচ্ছে ধর্মের দোহাই। নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি ভারতে কুম্ভমেলায় করোনা পূজার শেষ পরিনাম। কি বীভৎস্য নির্মমতা নিয়ে করোনা ঢুকে পড়লো ঘরে ঘরে, প্রদেশে প্রদেশে সর্বোপরি দেশময়। রাষ্ট্র বলছে করোনা শ্বাস-প্রশ্বাসে ছড়াচ্ছে। কাজেই সভা সমাবেশ এমন কি উপাসনালয়গুলোতেও কাছাকাছি মানুষের উপস্থিতি একদম নয়।

কেউ কি শুনছি সেই কথা? ধর্ম থেকে দূরে থাকা? সে কি? তা কেমন করে সম্ভব? অতএব জোর করে জড়ো হও। মারো, মরো  এবং নিঃশেষিত হয়ে যাও। একজন মানুষও বুঝতে চাইছে না যে, একবার সংক্রামিত হয়ে গেলে কোন উপাসনালয়ে তার সেবা  শুশ্রুষার কোন ব্যবস্থা নেই, প্রায় কোথাও। না ইমাম, না বিশপ, না পুরোহিত কেউই না। এদের কারো কাছেই মানুষ অথবা হিন্দু, মুসলমান বা কোন খ্রীষ্টানদের বাঁচানোর কোন শিক্ষা নেই। না, এরা কেউ দৈবশক্তির ধারক নন। কোন ধন্বন্তরী সমাধান এদের কারো কাছেই নেই। এই মহামারি থেকে বাঁচতে হলে ধর্ম নয়, বিজ্ঞানের দুয়ারে যেতে হবে। সেই দুয়ারের নাম হাসপাতাল। আর সেই ধর্মাশ্রমের সাধকদের নাম ডাক্তার। তাদের দেয়া ব্যবস্থাপত্র আমাদের সুস্থতার পথ করতে পারে। না, কোন হুজুরের ফুঁ, বিশপের বাণীতে কিংবা ঠাকুরের দেয়া সবচেয়ে দূষিত অথচ পবিত্র গঙ্গার জলে এ সম্ভব নয়। 

আমরা তো কেউ ধর্মবিদ্বেষী নই। তবে বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে যে চর্চা, সে কখনোই ধর্মকে মহিমান্বিত করে না। আমরা দারুনভাবে অবগত আছি আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই ইসলাম অনুশীলনকারীদের এই কুরবানী একটি মৌসুমী ব্যবসা। আপত্তি নেই, বাঁচতে হলে অর্থকে কুর্নিশ জানিয়েই চলতে হবে। শুধু তার পরিশীলিত প্রকরণ দরকার। বুঝে নেওয়া দরকার ধর্মকে, ধর্ম হিসাবে আর ব্যবসাকে ব্যবসা হিসেবে। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সে সকল শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে ছোরা হাতে ঈদুল আয্হার প্রভাতে। তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এবং রাষ্ট্রের পক্ষেও বলে দেওয়া দরকার, বাবারা তোমরা আজকের দিনে যা করছো, সেটা তোমাদের শিক্ষার অংশ নয়। এটি ব্যবসার অংশ।

এমন স্বচ্ছতার সরল প্রকাশ ওদের ভবিষ্যতে কশাই হতে উৎসাহিত করবে না। ওরা বুঝতে পারবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে এবং নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের এবং ভালোমন্দ উদরপূর্তির জন্য তাদের এ কাজ। এ কাজে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা কার্যত অন্যায়। ওদের বুঝাতে হবে করোনার ভয়াবহ রূপ। ওদের বলতে হবে তোমরা পশুর কাছাকাছি যাবে অতএব সাবধান। বার বার হাত ধুয়ে নেবে। মুখ  থেকে মাস্ক খুলবে না। এখন করোনার জাতাকলে পৃথিবীব্যাপী কোরবানী হয়ে যাচ্ছে সকল সৃষ্টির সেরা মানুষ। তার ছোবলে অনবরত ধাবিত হচ্ছে তারা মৃত্যুর পথে। স্বজন হারানোর কঠোর কান্না পৃথিবীর অজস্র ঘরে। এরই মধ্যে আমরা তৈরি হয়েছি মহান আল্লাহ্র রাজি খুশির জন্যে পশু কোরবানী দিতে। পবিত্র মক্কা মদিনা থেকে শুরু করে সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। অতপর হজে¦র নামাজ পড়ে পশু কোরবানী শেষে হাজ্বী সাহেবেরা পরিশুদ্ধ হন। পৃথিবীর অন্যত্র বসবাস করা মুসলমানেরা  সেই ধারা অনুসরণ করেন।

পৃথিবীব্যাপী চলছে মহামারী করোনার তান্ডব। সর্বত্র আজ  প্রচারিত হচ্ছে সাবধান বাণী।  এমনকি হজ¦ও এবার সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়। আমরা করোনা মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা জানাই। তিনি নির্ধারণ করুক এই পৃথিবী ছেড়ে আগামী দিনে কোন প্রাণের বেশি মৃত্যু হবে মানুষ না পশুর?

একদিন যা আত্মত্যাগের মহিমা প্রচারের জন্য প্রয়োজন ছিলো। আজ তা কেবল ব্যবসা। এখান থেকে আত্মত্যাগ বা মানুষের ভিতরের পশুবৃত্তির কোরবানীর যে ধারা ছিলো একদিন। আজ আর আমরা সেখানে নেই। এটা এখন কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার। মহিমা প্রচারের পরিবর্তে গরু, ছাগল, উট আর দুম্বার আকার আকৃতির দাম ও মাংসের স্বাদের দিকেই বেশি আলোচনা, বেশি নজর। কিছু করবার নেই, নদীর মতো বয়ে চলা এ এক পরম্পরা। এর বিরুদ্ধে তো নয়ই, পক্ষেও সবার বলার অধিকার নেই।  এ সকল কিছুর পরেও আমরা যেন করোনা প্রতিরোধের প্রতি আন্তরিক হই। আমরা যেন দূরত্ব বজায় রাখি সকল কর্মে একের প্রতি অন্যের। সাবধানে থাকি পশুর হাটে, ঈদের নামাজে মসজিদে, পশু জবাই থেকে শুরু করে বিতরণের সকল পর্যায়। তবেই এ করোনা একদিন হারিয়ে যাবে মানুষের প্রচেষ্টায়। তবে তা কোন ভুলে ভরা অনুশীলনে নয়। সঠিক স্বাস্থবিধি মেনে চলবার মধ্যদিয়ে। তবেই এই অস্থির ভীতির পৃথিবী আবার শান্ত স্বাভাবিক হবে। 

এবার ঈদে ভাল হতো যদি এসএম.এসে আসতো পশু। www.net-এ যদি হয়ে যেতো জবাই। নামাজ যদি হতো ফেসবুক লাইভে তবে কোলাকোলি নিশ্চয়ই হয়ে যেতো ইশারায়?   ঈদ মোবারক।


লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য।