করোনার কাছে হেরে যাচ্ছে অর্থবিত্ত

করোনার কাছে হেরে যাচ্ছে অর্থবিত্ত

করোনা সময়টা সত্যিই দুঃসময়। আজ অর্থ-বিত্ত কোন কাজে আসছে না। অঢেল অর্থ-বিত্তবানরাও চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। করোনার অজুহাত এবং ভেন্টিলেশন না থাকার অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগী। রোগী বলছি কেন, সমাজের নামি-দামি ও অর্থবিত্তের মালিকদের।

মাত্র কয়েকদিন আগে এসএ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই মারা গেছেন। কেবল একটি ভেন্টিলেশনের অভাবে ছোট ভাইর সামনে বড় ভাই এবং একটু পরে একই কারণে ছোট ভাইও মারা যান। অথচ এই প্রতিষ্ঠান চাইলে মুহূর্তে কয়েকশত ভেন্টিলেশন কেনার ক্ষমতা রাখেন। সামান্য অসুস্থ্য হলেও তারা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু করোনা সময়য়ে তাদের অর্থবিত্ত কোন কাজে আসেনি। প্রাণ দিতে হয়েছে সামান্য (অসামান্য) ভেন্টিলেশনের অভাবে। এটা তো গেল এসএ গ্রুপের কথা। এরকম অনেক গ্রুপের ক্ষমতা ও অর্থবিত্তবান হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয়। এখন আমাদের ভরসা কেবল সরকারি হাসপাতাল।

সবশেষ গতকাল বরিশালের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি হাসপাতাল রাহাত আনোয়ারের চেয়ারম্যান ডা. আনোয়ার হোসেন ঢাকার নামী-দামী হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। অথচ ডা. আনোয়ার করোনাকালীন সময় মানুষের সেবা দিতে দিতে নিজে আক্রান্ত হন। তিনি বরিশালের গরীবের ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেই গরীবের ডাক্তার উন্নত চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। কোন অর্থবিত্ত তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। এ কথা বলছি এই কারণে তিন এতটা অসুস্থ্য ছিলেন না। আমাদের ধারণা তিনি বরিশালে থাকলে এমন নাও হতে পারতো। তারপরও দেশখ্যাত অ্যাপোলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নিয়ে যওয়া হয়। কিন্তু সেই অ্যাপোলো করোনরা চিকিৎসা নেই জানালে পথে পথে ঘুরতে হয় শ্বাসকষ্টে ভোগা ডা. আনোয়ারকে। যান স্কয়ার হাসপাতালে, সেখানে ভেন্টিলেশন নাই জানিয়ে দিলে অন্য আরো এক নামকরা হাসপাতালে ছোটেন আনোয়ার। কিন্তু সেখানেও মেলেনি ভেন্টিলেশন। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন বাড্ডার হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পান ততক্ষণে তাঁর সঙ্গে থাকা অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। অগত্যা তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। এয়ার অ্যাম্বুলেঞ্চে নিয়েও তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কেবল করোনার কারণে আমাদের দেশের সম্মুখ সারির যোদ্ধারা প্রাণ দিচ্ছেন। এটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিচ্ছে। এই যখন বিত্তবানদের অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষের হালচাল আর বললাম না।

গত ২১ মে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নইম নিজাম করোনা পজেটিভ হন।  তিনি লিখেছেন সেই সময়ের দুঃসহ চিকিৎসা সেবার কথা। ২০ মে করোনা পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। তারা বলল, ২১ তারিখ লোক পাঠাবেন বাসায়। ২১ মে এভারকেয়ারের লোক এলো। তারা নাক থেকে নমুনা নিল পরীক্ষার জন্য। রাত ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানালো করোনা পজেটিভ হয়েছে। ২৪ মে তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন বসুন্ধরা গ্রুপসহ অন্যরা। ফোন দেওয়া হলো স্কয়ার হাসপাতালে। স্কয়ার থেকে এভারকেয়ার (আগের এ্যাপোলো) তার জন্য ভালো হবে জানানো হয়। এভারকেয়ারে নিয়মিত রোগী নইম নিজাম। করোনা শনাক্তও হয়েছে তাদের টেস্টে। এভারকেয়ার জানাল তারা চেষ্টা করছেন তাকে ভর্তি করানো যায় কি না। কিন্তু তারা ২ ঘন্টার মধ্যে আর কোন ফোন দিল না। তখন তিনি বুঝতে পারেন ওরা আসলে ভর্তি করবে না। ফোন করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদকে। তাকে অনুরোধ করেন স্কয়ারে তপন চৌধুরীকে একটু বলে দিতে। একটু বাদে তিনি জানালেন, সব তৈরি। গেলেই হবে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে স্কয়ারের জরুরি বিভাগে যান তিনি। সব কিছু দেখে তারা বললেন আপনার অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে। এই রোগীদের মাঝে আপনার ভর্তি হওয়া ঠিক হবে না। আর যে কারণে এলেন, ভেন্টিলেটর নেই আমাদের। অগত্যা বাসায় ফিরে যেতে হয়েছে। পরে বাসায় বসেই টোটকাসহ মুঠোফোন চিকিৎসায় তিনি সুস্থ্য হয়েছেন।

এমনসব ঘটনা আমাদের প্রত্যেক দিন মৃত্যুর মিছিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। করোনা শুনলে নামী-দামী হাসপাতালও কাউকে সেবা দিতে চায় না। কখনো ভেন্টিলেশন নেই, কোন কোন হাসপাতাল বলেন ব্যবস্থা নেই। এমন এমন নাই নাই শব্দের সঙ্গে এক একটি পাণ নাই হয়ে যাচ্ছে। এর দায় কে নেবে? 

আমরা বলতে চাই, আমাদের অবশ্য অবশ্যই সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার মান বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে দক্ষ জনবল এবং পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা দিয়ে স্বাবলম্বী করতে হবে। যাদের অর্থবিত্ত আছে তাদের কাছেও আমাদের আবেদন, আর বিদেশ কিংবা বেসরকারি চাকচিক্যের দিকে অর্থ ব্যয় না করে সরকারি হাসপাতালগুলো যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায় সেই দিকে নজর দিন। তাহলে অন্তত ভেন্টিলেশন নেই সেই অজুহাতে পথে পথে ঘুরে কোন ডাক্তার, বনেদি, ধনী অর্থবিত্তের মানুষদেরও প্রাণ দিতে হবে না। আমাদের আস্থার স্থান সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সগুলোকে স্বয়সম্পূর্ণ করার আর কোন বিকল্প নেই।