কাজী নজরুল বিশ্বমানবতার কবি

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতার মূর্ত প্রতীক বিশ^মানবতার কবি। বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে উঠেছেন। ধর্ম দিয়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ ঘোচাতে কলম চালিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে কোন ধর্ম দিয়ে আগলে রাখা সম্ভব নয়। কবির জন্মের ১২৩ বছর পরও নজরুলকে মুসলমানের কবি বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। নজরুল কেবল বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন। তিনি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট গালাগালিকে গলাগলিতে রূপ দিতে কাজ করে গেছেন। তাই তিনি কোন বিশেষ ধর্মের কবি নন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মজয়ন্ত্রী ও বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় নগরের উদীচী ভবনে কবি নজরুল ইসলামের জন্ম জয়ন্তীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বরিশাল নাটক।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নজরুলের সার্বজনীনতা নিয়ে আলোচনা করেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট বিশ্বনাথ দাস মুনশী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য ও বরিশাল নাটকের সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন লাবু, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ বরিশাল শাখার সাধারণ সম্পাদক সুখেন্দু শেখর সরখেল, বরিশাল নাটকের সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী, উদীচীর সাধারণ সম্পাদক ¯েœহাংশু বিশ্বস।
আবৃত্তি করেন, বরিশাল নাটকের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সঞ্জয় সাহা, রাখি শায়ন্তনী।সঙ্গীত পরিবেশন করেন, বিশ্বনাথ দাস মুনশী, পার্থ সারথী, মুক্তা, পিংকি সাহা, দুলারী, মিঠুন দাস, জুবায়ের হোসেন শাহেদ, শাকিল আহম্মেদ, আশরাফুর রহমান সাগর।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত মানব কল্যাণে কবিতা, গান, নাটকসহ বিভিন্ন উপন্যাশ লিখেছেন। নজরুল তার লেখনিতে কেবল মানুষের জয়গানের কথাই লিখে গেছেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগিরি রচনা করেছেন। তাঁর লেখা বিদ্রোহী কবিতা এক সঙ্গে বৃটিশ এবং ধর্মান্ধদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার একাংশে তিনি লিখেছেন, ‘বল মহাবিশে^র মহাকাশ ফাড়ি, চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা ছাড়ি, ভ্যুলোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময়, আমি বিশ^বিধাত্রির। মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ- রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর। বল বীর আমি চির উন্নত মম শির।’ এই লেখার পর কবিকে নাস্তিক ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত রচনা করায় নজরুলকে হিন্দুর কবি বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এরপর তিনি অসংখ্য ইসলামি গান ও গজল লিখেছেন। নজরুল কোন সমালোচনায় কান না দিয়ে লেখা দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি হিন্দু কিংবা মুসলমানের নয়। তিনি কেবল মানবজাতির কল্যাণের জন্য লিখেছেন। নজরুল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্বকে ঘুচিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছেন। তাই তো নজরুল লিখেছেন, ‘হিন্দু মুসলিম দুটি ভাই, ভারতের দুই আঁখি তারা, এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা’। এমন অসংখ্য কবিতা ও গানে হিন্দু-মুসলি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈনকে ধর্মীয়ভাবে আলাদা না করে মানুষ হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
বক্তারা বলেন, কবি নজরুল ইসলামকে বর্তমানে মুসলমানের কবি বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। প্রকৃতির কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, মানুষের কবি, মানবতার কবি, বিশ্বমানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে খ-িত করার অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে। সেই জন্য সত্যিকারের নজরুলের লেখা ও গান বেশি বেশি চর্চা করে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
এদিকে বুধবার সন্ধ্যায় বরিশাল শিল্পকলা একাডেমিতে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ ও কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান, ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান, স.ম. ইমানুল হাকিম, পাপিয়া জেসমিন।
আলোচনার আগে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর বিদ্রোহী কবিতার সঙ্গে অর্ধশতাধিক নৃত্যশিল্পী নৃত্য পরিবেশন করে। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের পরিবেশনায় গীতি নৃত্যালেখ্য ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।