কীর্তনখোলা নদীর জলে প্রেম চলে

কীর্তনখোলা ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক নদীর নাম। এ ধরণীতে জীবন চলুক বা না চলুক নদী জীবন চলে অবিরাম। নদীর জীবনের বৈশিষ্ট্যই হলো চলা। জীবনের চলাচলে অনেক গল্প চলে তাই নদী যেমন চলে আমাদের প্রেমও চলে।আমাদের দেশের সব নদীর মতো কীর্তনখোলা নদীও প্রতিনিয়ত বয়ে যায় চলে যায়।
বরিশাল শহর কেন্দ্রিক যাদের জীবন ছিলো বা আছে তাদের সোনালু স্মৃতিটা যেন ২১ কিলোমিটার এ নদী জুড়ে বয়ে চলে। শৈশব,কৈশোরে আর যৌবনে কীর্তনখোলা নদীর সাথে জীবন চলে, তৈরি হয় গল্প।
যেহেতু আজ "ভালোবাসা দিবস" তাই প্রেমের ভালোবাসার কথাই আওড়াবো।
বরিশাল শহরের বিনোদন কেন্দ্র বলতেই ছিলো কীতর্নখোলা নদীর পাড়।তা কখনো লঞ্চঘাট কখনো কেডিসি কিংবা কখনও ত্রিশ গোডাউন কেন্দ্রিযক।
আর এ শহরে প্রেম ভালোবাসার যেন মূল্যহীন ছিলো।নিরবতা ও নিস্তব্ধতা নিয়ে যুগলবন্দী হয়ে প্রেম আনন্দ ও বিরহ কথন-পর যেন এ নদীটাই ভরসা।তবে নদীর পাড় এখন সুসজ্জিত, বেঞ্চ আছে তাতে, দেখা মেলে যুগলদের।যদি বরিশাল শহরে আপনি প্রেম বিনিময় করে থাকেন আমি নিশ্চিত এ লেখা আপনাকে স্মৃতি আলিঙ্গন করবে।যদি ৯০ দশকের কথা বলি কেডিসি খুব জনপ্রিয় স্থান ছিলো তরুণ- তরুণীদের। আর আড্ডাবাজ মানুষের যেন প্রধানকেন্দ্র ছিলো কেডিসি। কি ছিলো কেডিসি? আমার দেখায় কেডিসি রেস্টুরেন্ট আর গোটা বিশেক চায়ের দোকান। তাতে ছেলেদের আধিপত্য বেশি ছিলো। আর ধুমপান করার নির্ভিক স্থান ছিলো স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের জন্য।তবে কেডিসি নিয়ে নেতিবাচক ধারণাও ছিলো।মূলত অর্ধশত'র বেশি নৌকা থাকতো নদীর পাড় জুড়ে। তাতে শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই উঠতেন এমন নয়।সব রকমের মানুষের বিনোদনের জন্য একমাত্র বাহন নৌকা। নদীর পাড়ে গেলেই মাঝিরা তাকিয়ে থাকতেন সাথে হাঁকডাকও দিতেন। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ ত্রিশগোডাউনে সংলগ্ন নদীর পাড়ে পাড় সুসজ্জিত হতে থাকলে নৌকা আর কেডিসির বিনোদনে ভাটা পরে।
তবে কীর্তনখোলা নদী যেহেতু বয়ে চলে আমারাও তার সাথে সাথে বয়ে চলি। ত্রিশ গোডাউন সংলগ্ন নদীর পাড় এখনতো পাল তোলা যৌবন।সকাল থেকে রাত ঐ নদী কেন্দ্রিক বিনোদন যেন আর থামলোই না।গভীর রাত অব্দি চলে দোকানীদের বেচাকেনা। এ সময়ে বরিশালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র এটাই। নদীর পাড়ে জুড়ে বেঞ্চগুলো ছাউনিহীন হলেও ফাঁকা থাকে না একমুহূর্ত।আসলে আমার দেখতে ভালো লাগে। যুগল প্রেমবিনিময়ের দর্শক হওয়াটা খুব আনন্দের।তবে সেটা আক্ষেপেরও হয়- হতে পারে কখনো। এ নদীর সাথে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে গান ও কবিতা জুড়ে আছে।
যেমন প্রেমের কবি, চির-আবেগের কবি মহাদেব সাহা তাঁর ‘এই যে বর্ষার নদী’ কবিতায় তিনি তাঁর প্রিয় নদী কীর্তনখোলাকে তুলে এনেছেন। বর্ষাকালের গ্রামের পরিবেশ ও নদীর ভরা যৌবনের কথা তুলে ধরেছেন। বর্ষাকালে নদীর উত্তাল ঢেউ এবং তার জলে খেলা করে চাঁদের আলো- তা অপরূপ ব্যঞ্জনায় চিত্রিত হয়েছে এভাবে, ” দ্যাখো এই বর্ষাকাল, গাঁ-গেরামে ফুঁসে ওঠে নদী/হাঁসেরা নেমেছে জলে আমাকে বিভোর করো যদি,/কীর্তনখোলার বুকে উঠিয়াছে পূর্ণিমার চাঁদ/সেখানে পরানসখা-তুমি আমি দুজনে বিবাদ।
”কালের বিবর্তনে আজ নৌকা ইঞ্জিন বসেছে,সরেছে ছাউনি তবে গোটা পাঁচেক নৌকা এখনো ছই নিয়ে এখানে চলে বেড়ায়। নদী,নৌকার সাথে প্রেমের কেমন যেন সম্পর্ক থাকে। তবে নেতিবাচক কিছু ঘটনা ঘটলেও প্রেম যেহেতু সুন্দর আমরা সে সৌন্দর্য নিয়ে বয়ে চলবো।এখনও কীর্তনখোলা নদীতে নৌকায় প্রেমিক প্রেমিকা চড়ে নিরবে নিভৃতে একটু প্রেমবিনিময় করবে বলে।প্রেম যে অবিরাম মধুর সাফল্য নিয়ে জীবন সঙ্গী হবে এমন না। তবে নতুন প্রেমের যেমন আজ স্মৃতি তৈরি করছে তেমন পুরনো প্রেমেও চাঙা কীর্তনখোলার নদী। কেউ স্মৃতি রোমন্থন করতে এসে কাতর হয়।কিছুদিন আগে নদীর পাড়ে সুস্মিতা রায় (ছদ্মনাম) এসেছে স্বামী সন্তান নিয়ে নৌকায় চড়তে, এসে নদীর জলের স্পর্শে প্রেম অনুভব হয়েছে কিনা জানতে আমি পারিনি তবে মাঝি লোকমান বলেন, "আমি আপুকে চিনি। উনি আগে আসতো। আমরা মাঝিরা এ নদীতে প্রেম বিরহের স্মৃতির গল্প নিয়ে জীবন যাপন করি।
" সুস্মিতা নৌকায় স্বামীর সাথে ছবি তুলেছে খুব আলিঙ্গন করে। আবার এ নদীতেই নতুন স্মৃতি তৈরি করতে প্রেমিকা নিয়ে এসেছে অমিয়। অমিয় ফুল হাতে হাঁটতে লজ্জা পাচ্ছে তবে প্রেমিকাও নাছোড়বান্দা ওর হাতেই ফুল দিয়ে কীর্তনখোলার নদী পাড়ে হেঁটে সকালে রোদে নৌকায় পা দিলো ঘন্টা দুয়ে থাকবে বলে। অনেক বছর পরে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আবারও এসেছে তাদের অনেকে,বখশিস দিয়েছে, নতুন জীবনের গল্প শুনিয়েছে মাঝিদের। একা এসেছেন অনেকে, স্মৃতি বিজড়িত স্থান ঘুরে সামান্য প্রশান্তি পেতে, শুনিয়েছেন কষ্টের কথা।নৌকার ধীরেন মাঝি ৩০ বছর জুড়ে কীর্তনখোলা নদীতে নৌকা বায় তবে বেশি ভাগ যাত্রী নাকি প্রেমিক প্রেমিকা। তৃতীয় পক্ষ হয়ে সামনে বসে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে দেখেছে মানুষের প্রেমের নানান রুপ।কখনো ঝগড়া, কখনো রোমাঞ্চ। তবে এখন ঘন্টা ভাড়া নেন ৩০০ টাকা অথচ দুইযুগ আগে এ ভাড়া ঘন্টা ৩০ থেকে ৫০ টাকা ছিলো। শুধু কি দাম বেশি তাই কম যাত্রী? সে জানায় মানুষের নিজের জন্য সময় কম মনে হয় তাই এখন আর আগের মত নদীর প্রেমে মানুষ পড়ে না। অনেক মাঝির স্বচ্ছলতা এনেছে কীর্তনখোলা নদী পাড়ের ত্রিশ গোডাউন। মাঝিরা জানায়, আগে তারা চরকাউয়া খেয়া ঘাটে যাত্রী পারাপার করতেন। তবে যাত্রী পারাপার থেকে বেশি আয় হয় না। এখানে বেড়াতে আসা লোকজন ঘণ্টা চুক্তিতে নদী ঘোরে। নৌকা বেয়ে তাদের সংসার চলে ।
নদী পাড়ের খাবার বিক্রেতা লোকমান বলেন," আমি যখন বসি ব্যবসা নিয়ে তখন মানুষ কম আসত। তবে বেশি আসতো তরুণ তরুণী।' আর এখন সবরকমের মানুষ দিন-রাত থাকে। বিকেলের সৌন্দর্যের পাশাপাশি রাতের সৌন্দর্যও উপভোগ করার মতো। নৌকায় করে মাঝ নদীতে রাতের বেলায় চাঁদের আলো দেখা,পাশাপাশি আকাশ আর নদীর রং বদলের খেলা দেখা এসব সৌন্দর্য প্রকাশ করার নয়। এখনও কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের জীবনের সাথে অনেক জীবন মিশে চলাচল করে। কারও জীবিকা নির্ভর করে। নদী যেমন চলে জোয়ার ভাটায়, তেমন মানুষের জীবনও বয়ে চলুক প্রেমের সৌন্দর্য নিয়ে