খাল সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না গেলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমবে না

খাল সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না গেলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমবে না

কবি জসিম উদ্দিনের একটা কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক- ‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখীর বাস, ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি...’। পানি গড়ানোর দৃশ্য দেখতে এখন আর রসুলপুরে যাওয়ার দরকার পরে না। এখন পানি গড়ানোর দৃশ্য বরিশাল নগরজুড়ে। আসমানীর ঘরের চালা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ার কথা লিখেছিলেন কবি। আমাদের নগরে বৃষ্টির পানি চালা দিয়ে নয়, বাড়ি ও সড়ক দিয়ে গড়াচ্ছে। আর বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ার এসে জুটি বাঁধায় এক অপরূপ দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।

বৃষ্টি কিংবা জোয়ারের পানি বরিশাল নগরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি করছে। অমাবশ্যার জোয়ারের পানিতে সারা দেশের সঙ্গে বরিশালও ভাসিয়েছে। কীর্তনখোলার পানি বরিশাল মহানগরীতে ঢুকে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। নগরীর প্রধান প্রধান সড়কেও হাঁটু সমান পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। জোয়ারের সময় পানি ঢুকলেও পানি অপসারণের ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ভাটার সময়ও নগরীর পানি কমছে না। মূলত বরিশাল নগরের খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রভাব এটি। এ ছাড়া অনেক খাল ভরাট করে সরু ড্রেন নির্মাণ করায় নগরীতে জমে যাওয়া পানি সহজে অপসারণ হচ্ছে না। গত প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বরিশালের বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতার সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো এই দীর্ঘ সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে কেবল আশ্বাসের পর আশ্বাস শোনা গেছে। বাস্তবে বরিশালের খাল সংস্কার কিংবা সংরক্ষণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর মন্ত্রণালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাঠানো হয়েছে এমন বাণী ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

৮০ এবং ৯০-এর দশকেও বরিশাল নগর বেষ্টিত ছিল খাল দ্বারা। অসংখ্য খাল জ্বালের মতো শহরকে স্নেহের মমতা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল। তখন জোয়ার-ভাটার পানি এসব খাল দিয়ে প্রবাহিত হলেও নগরী প্লাবিত হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি। কিন্তু আজকে চিত্র ভিন্ন। একটু বৃষ্টি কিংবা জোয়ার হলেই নগরজুড়ে পানির প্রবাহ দেখতে হয়। এই দৃশ্য একদিনে হয়নি। বরিশাল মহানগর পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়েছে। নগরের জলাবদ্ধতার জন্য পৌর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই এর জন্য দায়ি।

আজকের সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলের সামনে দিয়ে একটি খাল জেলখালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই খালের অন্য অংশ সার্কিট হাউসের সামনে দিয়ে গিয়ে ভাটার খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যা কীর্তনখোলায় মিশেছিল। ভাটার খালের একাংশ বরিশাল জিলা স্কুলের সামনে দিয়ে ব্রাউনকম্পাউন্ডে হয়ে বটতলা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নবগ্রাম এবং ঝালকাঠী জেলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ব্রাউন কম্পাউন্ডের খালের একটা অংশ সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপসোনিনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মুখ দিয়ে বগুড়া রোডের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনা দিয়ে শীতলাখোলা পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল। ওই খালটি আবার জেল খালের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই খালের সঙ্গে সদর রোডের একাংশ কালিবাড়ি রোড হয়ে বিএম স্কুলের সামনে দিয়ে শীতলাখোলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভাটার খালের অপর অংশ ডিসি লেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ডিসির বাংলোর পেছন দিয়ে বরিশাল শের-ইবাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরদি খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদিকে আমনতগঞ্জ খালটি আমানতগঞ্জ পাওয়ার হাউস থেকে নাজিরের পুল পর্যন্ত জেল খালে প্রবাহিত ছিল। এর একটি অংশ সোনালী আইসক্রিম মোড় হয়ে আবার আমানতগঞ্জ খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

অন্যদিকে জেল খাল নথুল্লাবাদ পর্যন্ত গিয়ে একটি শাখা লাকুটিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্য শাখাটি জিয়া সড়কের মধ্যদিয়ে আবার নবগ্রাম খালের সঙ্গে যুক্ত হয়। নথুল্লাবাদ মহাসড়কের দুই পাশে দুটি খাল ছিল। যা একদিকে জেল খাল, লাকুটিয়া খাল অন্যদিকে সাগরদি খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নগরের প্রাণকেন্দ্র ফকিরবাড়ি-সদর রোডের মুখে সাবেক পৌস সুপার মার্কেট ছিল একটি বড় পুকুর। এই পুকুরটির সঙ্গে ছিল ফকিরবাড়ি এবং সদর রোড খালের সঙ্গে যুক্ত। সদর রোডের কাটপট্টির মুখ বরাবর খালটির ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ হয়। তবে এখানে খালের প্রবাহ ঠিক রাখতে ওপর দিয়ে কাঠের অস্থায়ী ব্যবস্থা করা ছিল। এতো কেবল কয়েকটি খালের কথা বলর চেষ্টা। এরকম অসংখ্য খাল বরিশাল নগরকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। সব খালের কথা উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

মূলত বরিশাল পৌরসভা থাকাকালীন বরিশালের খাল ভরাট শুরু হয়। পৌরসভা প্রথম বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বটতলা খাল ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ করে। বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ভরাট কাজ আরো দ্রুতগতিতে শুরু হয়। একই সঙ্গে নগরের বড় বড় পুকুরগুলোও ভরাট করে সিটি করপোরেশন। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় নবগ্রাম রোডের পাশে থাকা প্রবাহিত খাল ভরাট করে সরু ড্রেন নির্মাণ করায়। একই সময় সার্টিট হাউসের পাশদিয়ে প্রবাহিত ভাটারখাল ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করায়। এখন শহরের মধ্যে মাত্র কয়েকটি খাল মৃতপ্রায় অবশিষ্ট আছে। তাও ভরাট, দখল-দুষণে হারিয়ে যাচ্ছে। বরিশাল নগরীতে লোকসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি পানি অপসারণ ব্যবস্থা। অনেকক্ষেত্রে আরও সংকুচিত হয়েছে। ফলে নগরবাসীর ব্যবহার্য পানি অপসারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তারওপর অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের পানি ঢুকে পড়লে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীদের। অধিকাংশ খাল ভরাট করে সরু ড্রেন নির্মাণ এবং দীর্ঘদিন সংস্কার ও সংরক্ষণ না করায় অবশিষ্ট খালে পানি ধারণ করতে পারছে না। এই দুর্ভোগ কমাতে হলে আমাদের অবশিষ্ট খালগুলো সংষ্কার এবং সংরক্ষণ করতেই হবে।

যদিও গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় খাল সংস্কার ও সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি শোনানো হচ্ছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোন খাল থেকে এক মুঠো মাটি কাটা হয়েছে এমন নজির নেই। তবে খাল কাটার শোডাউন হয়েছে একধিকবার। এ ছাড়াও খাল দখলদারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন নজিরও নেই। তত্তাবধায়ক সরকারের সময় এবং জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামানের সময় খালগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল। খালের অংশ লাল দাগ দেওয়া হয়েছে। ওখানেই শেষ। আর এগোয়নি সে কাজ। দখলদাররা বহালতবিয়তে আছেন। একই সঙ্গে জেল খালের বেশ কয়েকটি অংশে বক্স কালভার্ট করে ভরাটে উৎসাহিত করা হয়েছে। নাগরিক দাবির প্রেক্ষিতে সেগুলো অপসারণ করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ফলে এক সময় জেল খাল দিয়ে বয়ে চলা প্রবাহের সঙ্গে নৌযান চলাচল করতো। আজ আর সে সুযোগ নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। এটা যে কেবল জেল খাল তা নয়, নগরের অধিকাংশ খালই এভাবে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে প্রশাসনিক সহযোগিতায়।

এখনও সময় আছে, বরিশালের অবশিষ্ট খালগুলো সংষ্কার এবং সংরক্ষণ করলে কিছুটা হলেও জলাবদ্ধতা কমবে। তা না হলে এক সময়ের ভেনিস খ্যাত বরিশাল নগরী বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে পরিচিতি পাবে। ভেনিস শহর না হোক, অন্তত জলাবদ্ধতা মুক্ত নগর গড়ে তোলা এখনও সম্ভব। সেজন্য আমাদের বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা জরুরী। সেক্ষেত্রে ড্রেনের আউটলেট যাতে মূল খালের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয় সেদিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরী। আর জেলখালসহ অন্যান্য খালে যাতে পানি প্রবাহ বাড়ে তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বরিশাল নগরটি রক্ষায় কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তবমূখি পদক্ষেপ নিয়ে খাল সংস্কার, সংরক্ষণ এবং দখল হওয়া খাল উদ্ধারে শূন্য সহনশীল নীতি দেখাতে হবে।