চুরির ঘটনায় ফাঁসছেন বিমান ও কাস্টমসের সাতজন, ৪ জন সাসপেন্ড

চুরির ঘটনায় ফাঁসছেন বিমান ও কাস্টমসের সাতজন, ৪ জন সাসপেন্ড

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউজ থেকে এন-৯৫ মাস্ক চুরির ঘটনায় ফাঁসছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও ঢাকা কাস্টমস হাউজের সাতজন। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আলোচিত এ চুরির ঘটনায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে আরও তিনজনকে। ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে কর্র্তৃপক্ষ। কয়েক দিনের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় চুরির মামলা হতে পারে।

করোনা আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্সদের  জন্য বিদেশ থেকে আনা এন-৯৫ মাস্ক বিমানবন্দরের মতো নিিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী থেকে চুরির ঘটনায় বিস্মিত তদন্তকারীরা। তারা জানিয়েছেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ৭ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মাত্র ৬০ পিস মাস্ক চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এসেছে’। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের (বেবিচক) তদন্ত প্রতিবেদনে বিমান ও কাস্টম হাউজের কিছু কর্মকর্তার সংঘবদ্ধ দুর্নীতির ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে তাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।

মাস্ক কেলেংকারির আলোচিত এ ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত ৬০ পিস মাস্ক চুরি করিয়ে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট করার হীন তৎপরতা চালানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকালে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নমুনা দেখার নাম করে ৩টি বাক্স (একেকটি বাক্সে ২০টি করে মাস্ক) সরিয়ে ফেলেছে তারা। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া যেকোনো অনিয়ম ঠেকাতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটির অনুলিপি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কেও দিয়েছে বেবিচক। বিমানবন্দরের আমদানি-রপ্তানি শাখার সিসি ক্যামেরার ফুটেজও জব্দ করেছে বেবিচক। চুরিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নিতে বিমান ও কাস্টম হাউজকে গতকাল রবিবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশন বলছে, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) তাদের কাছে তিন লাখ পিস এন-৯৫ মাস্ক আনার অর্ডার করে। তারা দ্ইু দফায় চীন থেকে ৮৬ হাজার পিস মাস্ক এনে দেন। এরপর ১০ জুন তৃতীয় দফায় ১ লাখ ৮শ পিস মাস্ক আনা হয়। এই চালানেই মাস্ক চুরির বিষয়টি নজরে আনে সিএমএসডি। কিন্তু বিমানবন্দরে মাস্ক চুরির তদন্ত না করে সন্দেহের তীর তাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। পরে তারা বেবিচককে তদন্ত করার অনুরোধ করেন।

জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, তমা কন্সট্রাকশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিমান ও কাস্টম হাউজের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি এবং যারা এই ঘটনায় সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন সাহস না পায়।

তমা কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) আমাদের ৩ লাখ পিস এন-৯৫ মাস্ক আনার অর্ডার দেয়। চীন থেকে প্রথম দফায় ৬০ হাজার পিস ও ২য় দফায় ২৬ হাজার পিস মাস্ক আনা হয়। সিএমএসডি সেগুলো গ্রহণ করে। ৩য় দফায় ১ লাখ ৮শ পিস আনার পর সিএমএসডি জানায়, চালানে মাস্ক কম রয়েছে। অভিযোগ আসার পর আমরা বিষয়টি সিঅ্যান্ডএফকে অবহিত করি। তারা বাক্সগুলো গণনা করে ৩টি কম পায়। বিষয়টি আমরা সিএমএসডিকে জানালে তারা ৩য় চালানটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত ১১ জুন সিএমএসডি বিষয়টি মিডিয়াকে জানিয়ে দেয়। আর আমরা বেবিচকের কাছে চিঠি পাঠাই। তারা তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করেছে। এখন সিএমএসডি নতুন করে ২০ হাজার করে মাস্ক দেওয়ার জন্য বলছে। আমরা মাস্ক সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের মতো একটা কোম্পানির যথেষ্ট পরিমাণ সুনাম নষ্ট হয়েছে। চুরির ঘটনায় জড়িতদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, আমরা কোনো প্রতারণা করিনি।’

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরের কার্গো হাউজের কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে কীভাবে ও কেন ৬০ পিস মাস্ক চুরি হলো তার একটা ধারণা পাওয়া গেছে। প্রথমত জানা গেছে, এ মাস্ক চুরির নেপথ্যে তেমন আর্থিক লাভের কোনো বিষয় ছিল না। যারা চুরি করেছেন- তারা শুধু স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। এতে কার্গোর নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশনের কর্ণধার আতাউর রহমান ভুইয়া ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িত। তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। মাত্র ৬০ পিস মাস্ক চুরির ঘটনাকে এত বিশাল কেলেংকারি হিসেবে প্রচারের নেপথ্যে রয়েছে মূলত তার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণœ করা ও এলাকায় তার সুনাম নষ্ট করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তার কাজটা যাতে আটকে যায়- সেজন্য এলাকার প্রতিপক্ষের প্রভাবশালীরা সুপরিকল্পিতভাবে ‘তিলকে তাল করতে’ সক্রিয় রয়েছে। আতাউর রহমান ভুইয়া নিজেও ঘটনার নেপথ্য নায়কদের শনাক্ত করার জোর আবেদন জানিয়েছেন।

বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৩ জুন তমা কন্সট্রাকশনের এমডি মাস্ক চুরির ঘটনার তদন্ত চেয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ফাহিম ফাইভ স্টার নামে সিঅ্যান্ডএফের মাধ্যমে ১০ জুন চায়না থেকে ২৬৫ কার্টন এন-৯৫ মাস্ক আনা হয়। এগুলো আমদানি শাখার শেডে রাখা হয়। স্যাম্পল দেখার জন্য কাস্টম ও বিমান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাক্স খোলেন। পরে কাভার্ড ভ্যানে করে সেগুলো সিএমএসডিতে নেওয়া হয়। পরে তারা জানান, মাস্ক কম। আমরা পর্যালোচনা করে দেখি ৩টি বাক্স চুরি হয়ে গেছে। একেকটি বাক্সে ২০টি করে মাস্ক ছিল। এরপর আমদানিকারক শাখার সিসি ক্যামেরার ফুটেজগুলো তদন্ত করার অনুরোধ করা হয় বেবিচককে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচকের সদস্যকে (সিকিউরিটি) প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বিমান ও কাস্টম হাউজের কর্মকর্তাদেরও রাখা হয়। তারা এক সপ্তাহ ধরে তদন্তের পর গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনের সাতজনের নাম রয়েছে। এরই মধ্যে কাস্টমসের এসআই শাহজাহান সিরাজী ও সিপাহী সাখাওয়াত হোসেন এবং বিমানের ২ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও তিনজনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ফুটেজে দেখা গেছে, কাস্টমসের এক সিপাহী মাস্কের বাক্স খুলছেন। তার পাশে আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে রয়েছে কার্গো শাখাকে আরও ঢেলে সাজাতে হবে, সিসি ক্যামেরা বাড়াতে হবে। যারা অপরাধ করবেন তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে পুলিশের হেফাজতে দিতে হবে। কোনো অপরাধীর সঙ্গে আপস করা যাবে না।