ছবি তুমি কোন কথা কও

যেখানে এসে আজ আটকে গেলাম। অনেকদিন এমন নির্মল প্রাসাঙ্গিক ছবির রূপ দেখিনি। যে ছবির প্রত্যাশা থাকে নীরবে মনের গভীরে, অপ্রকাশ্যে। ঠিক তেমনই এক ছবি। মনে মনে ভাবছি ঠিক দেখছিতো? ক্যামেরার কোন যান্ত্রিক ত্রুটি নয়তো? অথবা সম্পাদনার অটো কাট-পেস্ট? মিলাতে পারছি না।
মনে হয় যেন আজ বলি কবির ভাষায় ‘তুমি কি কেবলই ছবি’? হায় ছবি, কেন হয় না এমন ছবি, প্রতিদিন- সর্বত্র? আমরাতো জানি ছবি কখনো হাসায়। কখনো বাধ্য করে কাঁদতে। ছবিই পারে মানুষকে(?) লজ্জার নিন্দাপংকে ডুবিয়ে দিতে। ছবি পারে এক দেশ জাতিকে বুক সোজা করে দাঁড়তে। ছবিই পারে প্রতিদিন আমাদের যোগ্য করে তুলতে। তবে প্রশ্ন কোন সে ছবি? যা প্রতিদিন মুহূর্তে মুহূর্তে ক্যামেরা উল্টো করে তুলি? যার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নাম সেলফি? অনেকদিন খুঁজেছি এর বাংলা শব্দরূপ কি হতে পারে। আপনাকে নিয়ে আপনি বিভোর, অথবা আমারই আমি, অথবা আমি এবং আমার প্রচার, অথবা আমাকে বাদ দেবার তুমি কে হে, এমন প্রতিবাদি কোন শব্দ? ঠিক জানি না। তবে নিশ্চয়ই আছে। আমার অজ্ঞতা এখনো তাকে খুঁজে পায়নি। তাই বলে এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই, যে আমি সেলফি বিরোধী। না, আমিও সুযোগ পেলেই সেলফি তুলি। তারপরে দেখে দেখে মনে হয়, ধুর এইতো চেহারা তার আবার সর্ব ভঙ্গির ছবি!
তবে সেলফির অনেক মজাদার বিভৎস রূপ আছে। যেমন এক সেলফি প্রেমির মনে হলো পাশাপাশি এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে লাফ দিয়ে যাবার সময় তিনি সেলফি তুলবেন। যেই কথা সেই কাজ। সবই ঠিকঠাক ছিলো, শুধু নিচে পড়ে পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার। ফোন চেক করে পাওয়া গিয়েছিলো ছবিতে উনি নেই, সেখানে শুধু খালি আকাশের ছবি। অদ্ভুতভাবে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে পুরষ্কৃত হয়েছিলো ভারতের এক ফটো গ্রাফার। তিনি ক্যাপশনে লিখেছিলেন ‘উড়ন্ত সেলফি’। যে লোকটির ছবি সংক্রমিত হয়েছিলো প্রথম, মনে পড়ে? কুমিরের মুখে মাথা দিয়ে সেলফি? আমি ঠিক জানি না সে বেঁচে ছিলো কি না? এগুলো সবই ব্যতিক্রমী প্রয়াস। যে কারণে এমন ছবিগুলো সংক্রামিত/ভাইরাল হয়েছিলো বিশ^ব্যাপি।
আমি আজ এমন একটি ছবির কথা বলবো। আমাদের দেশের গতানুগতিকতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক ছবি। গত ২০ সেপ্টেম্বর মাননীয় পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আসেন গিয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সেই সভার একটি ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। এরকম প্রতি, উপ, পূর্ণ মন্ত্রীদের অজ¯্র ছবি প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে আসে এবং চলেও যায়। আমরা সেইসব ছবি খুব একটা মনে রাখতে পারি না। বা এভাবেও বলা যায় সত্যিকার অর্থেই খুব একটা প্রয়োজনও পরে না। কারনটা খুব স্পষ্ট সাধারণ মানুষের এর সঙ্গে লাভ লোকসানের খুব একটা সম্পর্ক থাকে না। তবে আজ আর তেমনটা হলো না। চোখ আটকে গেল একটি ছবির সঙ্গে। কারণ ছবিটা গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করেছে তাই। তাহলে কি সেই ব্যতিক্রম, যা অনেকের সঙ্গে মিললো না? যা আমাদের অতি সহজাত চোখকেও স্থির করে আটকে দিলো? বিষয়টি অতি সহজ সরল এবং নিতান্তই স্বাভাবিক। অথচ আমরা প্রয়শঃই পারি না এমন কার্য সাধন।
আমরা জানি বা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সেটি হলো কোথাও কোন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদস্থ কেউ, কিংবা ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা বা যদি এমন হয় এসেই পরলেন, কোন মন্ত্রী বা মন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ। তবে কি হয় তখন? মান্যবর অতিথির আপ্যায়নে সর্বপ্রথম ওই প্রতিষ্ঠান প্রধান তার নিজ অবস্থানের চেয়ারখানা বাড়িয়ে তাকে বসতে দেন। এটা এক অসুন্দর হলেও মোটামুটি নিয়মরূপেই প্রচলিত আছে সর্বত্র। এমন একটি ধারা বিরোধী ভাবনা ভাববার মত কোন যোগ্যতর মানুষ আছে, এটা ভেবেই যেন দারুনভাবে অবাক এবং বিস্মিত হয়েছি।
দেখলাম মান্যবর মন্ত্রী, বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট কমান্ডরকে (যদিও মহামান্য হাইকোর্টের ১২/০৭/২০১৭ তারিখের নির্দেশে এই পদ স্থগিত করে জেলা প্রশাসকের উপর এর দায়িত্বভার অর্পন করেছেন) তার সম্মানিত চেয়ারে বসিয়েই মাননীয় মন্ত্রী তার ডান পাশের চেয়ারে বসে সভায় মননিবিষ্ট আছেন। ভাবুন তো একবার কি অসাধারণ বিষয়টি। কতটা ব্যতিক্রম, কতটা ধারা বিরুদ্ধ এবং একই সঙ্গে কতটা সঠিক? তিনি চাইলেই তো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের চেয়ারটায় বসতে পারতেন? হয়তো মুক্তিযোদ্ধা নেতারা ব্যবস্থাটা সেভাবেই করেছিলেন। তেমনটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীর ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে বিষয়টি তেমন হলো না। তিনি সম্মানিত করেছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বড় ভাই তুল্য অগ্রজ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে। এমন নির্ভেজাল ব্যাতিক্রমধর্মী প্রয়াসের জন্য অভিনন্দন এবং অভিবাদন মাননীয় মন্ত্রী জনাব জাহিদ ফারুক শামীম আপনাকে।
সুন্দর চিরদিনের জন্য সুন্দর। সবার জন্য সমান সুন্দর, তেমনি সত্যও। আমরা জানি, সুন্দর ও সত্যের কোন জাত নাই। তাইতো ওরা মুক্ত সদাই। শিক্ষা, সভ্যতা, নম্্রতা এবং বিচক্ষনতায় যে কর্ম, সে ধীরে ধীরে দেদিপ্যমান হবেই। মাননীয় মন্ত্রী, হয়তো সবার চোখে পড়েনি এমন ছবি। তারপরেও বলি এমন কর্মই আপনাকে ধীরে ধীরে স্মরণীয় করে তুলবে। মানুষ কৃতজ্ঞ হবে আপনার প্রতি। যেমনটা নিশ্চয়ই হয়েছিলেন সেদিন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে উপস্থিত কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার এবং উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ।
মানুষের দম্ভ, ক্ষমতা পদ মর্যাদা সর্বদাই সুন্দর ও সত্যের সঙ্গে থাকতে চায়। আমরাদের অতি স্বার্থের উদ্যোগ তাকে ব্যহত করে। নিন্দিত করে, ঘৃণিত করে এবং এক সময় নিরবে প্রত্যাখান করে। মানুষ মূলত মানুষের যোগ্যতার উন্মেষ দেখতে চায়। মানুষ চিরদিনই অযোগ্যতা, অসুন্দর, আর অপ্রাসঙ্গিক দম্ভের নিন্দা করে। হয়তো সবাই তা শুনতে পায় না। মূলত সে দোষটা কানের নয়, অজ্ঞতা অনুশীলনের। আমরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উৎসাহিত করি, মেনে চলি।
কেন যেন ভাবতে পারি না আমরা, একজন শিক্ষামন্ত্রী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এলে ওই প্রতিষ্ঠান প্রধান, হোক সে হেডমাষ্টার কিংবা অধ্যক্ষ। তিনি তার আসন ছেড়ে দেবেন। বিধান না হলেও এটাই নিয়ম অথবা বলা যায় বাধ্যবাধকতা। তারপরেও কি ভাবতে পারি না, কোন সুযোগ কি নেই ভাববার? মাননীয় মন্ত্রী এমন পরিস্থিতিতে বলবেন, আপনারা আপনাদের নিজ চেয়ারে বসুন। কারণ ওই চেয়ারটি এই প্রতিষ্ঠান প্রধানের। আমাকে ভিন্ন আসন দিন আমি সেখানেই বসব! আমরা কি ভাবতে পারি যদি সত্যিই এমন হয়, তখন ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের আনন্দ, অস্তিত্ব, অবস্থান তাকে কতটা সৎ, যোগ্য করে তুলবে? কতটা দৃঢ় হতে পারবে সে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে?
খুব ভালো কোন কিছু না পারাটা তেমন দোষের কিছু নয়। কিন্তু পারতে না চাওয়া/শিখতে না চাওয়া খুব দোষের। কখনো কখনো ক্ষমতা, দম্ভ, সমৃদ্ধি, জনপ্রিয়তা, লোকবল মানুষকে তার যথার্থ অবস্থা অনুধাবনে সহায়তা দেয় না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ্য প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তখন বি.সি.সি.র অত্যান্ত জনপ্রিয় মেয়র শওকত হোসেন হিরন। একদিন হঠাৎ-ই বরিশালের সমৃদ্ধ নাট্যসংগঠন শব্দাবলীতে উপস্থিত হলেন, বলা যায় প্রায় পৃথিবীশ্রেষ্ঠ মূকাভিনয় (মাইম) শিল্পী পার্থ প্রতিম মজুমদার। আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে উপস্থিত হলেন মেয়র। সকলের মুখে এই গুণি শিল্পীর কথা শুনে শুনে এক সময় প্রধান অতিথিত বক্তব্য দিতে উঠে তিনি শুধু বললেন। ‘আমি আজ কোন কথা বলবো না, তাছাড়া এই গুণি মানুষ সম্বন্ধে তেমন কিছু বলবার যোগ্যতা আমার নেই। তাই আজ এখানে উপস্থিত সাংবাদিক বন্ধুদের বলবো তোমরা আজ সারাদিন বাথরুম লেট্রিন রাস্তা উদ্বোধনের যত ছবি আমার তুলেছ তার একটি ছবিও কোখাও ছাপাবে না। আজ তোমাদের প্রতি আমার একটি বিশেষ অনুরোধ, তোমরা আমার আজকের এই অনুষ্ঠানের ছবি অবশ্যই ছাপাবে। আমি ভাবতে পারছি না, আমি আজ এমন একজন বিশ^ শ্রেষ্ঠ মানুষের পাশে বসে আছি’।
মানুষের এই উপলব্ধিগুলো খুব দামি। অন্যের বিশালত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যেই নিজের ব্যপ্তির বিস্তার ঘটে। অন্যের আসন নিজের মনে হলেই, নিজের আসনখানা ধীরে ধীরে ক্ষিণ হতে হতে একসময় মাটি স্পর্শ করে। সেদিন বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আপনার উপস্থিতি এবং আনুষ্ঠানিকতা যথার্থ পূর্ণ হলেও একটি ছোট্ট দৃষ্টিগোচরহীনতার কারণে পরিপূর্ণ হলো না! সেটি হলো জেলা ইউনিট কমান্ডারের বা পাশের চেয়ারটিতে ডেপুটি কমান্ডার কিংবা অন্য কোন বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধারই বসা উচিৎ ছিলো। জানি না বিষয়টি কেমন করে ঘটলো কার অতি উৎসাহে? তারপরেও আপনার উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ওই ছবি আমাদের অনেক কিছু বলছে। আমরা যেন তা বুঝতে চেষ্টা করি।