জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছর: আইনি গ্যাঁড়াকলে বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছর: আইনি গ্যাঁড়াকলে বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছর। এই এক বছর বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হবে। এমন ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক ফয়সালা’র ওপর ভরসা রাখছেন বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় সম্পৃক্ত শীর্ষ আইনজীবীরা।

নিরপেক্ষ সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতারা রয়েছেন মামলা কিংবা সাজার ঝুঁকিতে। পুরনো মামলার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়তই নতুন মামলা হওয়ার খবর আসছে। যার প্রায় সবই পুলিশের ওপর হামলা, নাশকতা কিংবা বিস্ফোরক আইনে। আসামি করা হচ্ছে শত শত নেতাকর্মীকে। প্রায় প্রতিদিনই গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। জামিন নিতে নেতাকর্মীদের ছুটতে হচ্ছে অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে। গ্রেপ্তার ও হয়রানির আতঙ্কে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।

অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগে করা পুরনো মামলা এবং সাজার বিরুদ্ধে সহসাই আপিল নিষ্পত্তির উদ্যোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীরা। এ তালিকায় রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুকসহ অন্তত ১০ শীর্ষ নেতা।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার পুরনো মামলা সচলের পাশাপাশি নতুন মামলার কৌশল অবলম্বন বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীদের ইঙ্গিত দেওয়ার খবর দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীরা বলছেন, দেড় দশক ধরে মামলা, জামিন আর বিচার নিয়ে কঠিন সময় যাচ্ছে তাদের। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে সারা দেশে এক লাখের বেশি মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপির ৩৭ লাখ নেতাকর্মীকে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এই সময়ে গত তিন মাসে সারা দেশে কয়েকশ মামলায় বিএনপির অন্তত ৭৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৩ হাজার নেতাকর্মী রয়েছেন কারাগারে। গত আড়াই মাসে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৫০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী। আদালতের কর্মদিবসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পুলিশের করা মামলায় আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে নেতাকর্মীদের ভিড় বাড়ছে। অতীতে এত বেশিসংখ্যক আগাম জামিনের নজির নেই বলে জানান আইনজীবীরা।

আইনজীবীদের অভিযোগ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে আদালতে ব্যস্ত রেখে নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া, শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও কেন্দ্রীয় ও জনপ্রিয় নেতারা যাতে নির্বাচনে আসতে না পারেনএটি তারই অপকৌশল। আইনের বেড়াজালের এই সংকটময় পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবেএমন প্রশ্নে দলটির শীর্ষ আইনজীবীরা বলছেন, মামলাগুলো রাজনৈতিক। এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘রাজনৈতিক ফয়সালা’তেই সমাধান হতে পারে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে মামলা, জামিন আইনগতভাবেই সামাল দেওয়া হচ্ছে। তবে কয়েক মাস ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে দারুণ অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। সাধারণত নির্বাচনের প্রাক্কালে এসব ঘটনা ঘটে।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতি কখন কোনদিকে যায় সেটা সরকারও বুঝতে পারে না। যারা বিরোধী দলে থাকে তারাও জানে না। সরকারি দল চায় ক্ষমতায় থাকতে আর বিরোধী দল চায় ক্ষমতার পরিবর্তন। এখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মামলা আরও বাড়বে কি না, নেতাকর্মীরা কারাগারে থাকবে কি না, এর গতি প্রকৃতি কী হবে এটা সময়ই বলে দেবে।’

মার্চ নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘যেভাবে মামলা-গ্রেপ্তার চলছে, তাতে আমাদের তো কৌশলগত অবস্থান নিতেই হবে। পাশাপাশি আন্দোলন চলতে থাকবে। সবকিছুর জন্য একটু সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এ সময় সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে নেয় তাহলে তো কথাই নেই।’

খালেদা জিয়াসহ যেসব নেতার মামলা আলোচনায়: দুর্নীতির দুটি মামলায় ১৭ বছরের কারাদ-প্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে করা আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাতে সাত বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলটিও হাইকোর্টে দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে।

দুদকের প্রধান কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতে মামলাগুলো বছরের পর বছর পড়ে ছিল। পুরনো মামলা নিষ্পত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। আমরা আরও কিছুদিন দেখব। যদি তারা (খালেদা জিয়ার আইনজীবী) কোনো উদ্যোগ না নেন, তাহলে আমরাই আপিল শুনানির উদ্যোগ নেব।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত হলে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। যদি নজির থেকেও থাকে এটা দেখার দায়িত্ব কার? এখন ইসি যদি কোনো ভুল করে সেটার দায় তো দুদক নেবে না।’

তবে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের আইনজীবীরা বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে যেহেতু নিষ্পত্তি হয়নি, তাই খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা নেই।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির শীর্ষ নেতা গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে করা মামলার কার্যক্রম বাতিল প্রশ্নে দেওয়া রুল খারিজ করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। মামলাটি বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে করা আবেদন হাইকোর্ট খারিজ করেছে। সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছে। বিচারিক আদালতে এ মামলায় শেষ সাক্ষীর (তদন্ত কর্মকর্তা) সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার দুর্নীতির আরেকটি মামলায় মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার দুর্নীতির মামলায় পুনঃতদন্ত ও সাক্ষীর পুনরায় জেরা চেয়ে আবেদন উচ্চ আদালত খারিজ করে দিয়েছে। বিচারিক আদালতে আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনও শেষ হয়েছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমানকে ১৩ বছর সাজা দিয়েছিল বিশেষ আদালত। হাইকোর্টে খালাসের পর আপিল বিভাগ মামলাটি ফের হাইকোর্টে পুনঃশুনানির জন্য পাঠিয়েছে। একই ধরনের মামলায় বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে ৯ বছরের কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। হাইকোর্টে খালাসের পর এই মামলাটিও আপিল বিভাগের আদেশে পুনঃশুনানিতে আসে। এর মধ্যে আমানের মামলাটি রয়েছে শুনানির শেষ পর্যায়ে।

দুর্নীতি দমন ব্যুরোর (বর্তমানে দুদক) নোটিসের জবাবে সম্পদের হিসাব বিবরণী না দেওয়ায় জয়নাল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০০০ সালের ১৯ জানুয়ারি। মামলায় অভিযোগ গঠনের বৈধতা নিয়ে আবেদন করলে ২০১০ সালের ১ জুন হাইকোর্ট রুলসহ মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয়। সম্প্রতি ২৩ বছরের পুরনো এ মামল সচলের উদ্যোগ নেয় দুদক। গত ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল খারিজ করে মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়।

গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় এক মাস ধরে কারাগারে আছেন। গত ২৬ ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্লট জালিয়াতি ও নকশাবহির্ভূত হোটেল নির্মাণের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। বিএনপির এই নেতা যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন গুঞ্জন রয়েছে।

ঢাকার বিচারিক আদালতে দুদকের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্থগিত থাকা মামলাগুলো এখন আইন মোতাবেক নিষ্পত্তি হয়ে আসবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলের নেতারা কাকে দায়ী করে কী বললেন সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়। এখানে কোনো চাপ বা রাজনৈতিক বিবেচনার সুযোগ নেই।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী হবে সেটি দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিদ্ধান্ত নেবে। তবে রাজনীতিতে অনিবার্যভাবেই বিরোধ, মত ও পথের অমিল থাকে। কিন্তু আদালতকে ব্যবহার করে সরকারের জেল, জুলুমসহ সার্বিক কর্মকান্ডে মানুষ কিন্তু সরকারের সঙ্গে নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্রের শক্তি চলে আদেশে। আর রাজনীতি চলে রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তে। তাই আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের নামে মামলা কিংবা সাজার বিষয়টি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ফয়সালার ওপর নির্ভর করে। আমরাও সে অপেক্ষায় আছি। এখন সেটি কতদিন লাগতে পারে তা সময়ই বলে দেবে।’