ঝুঁকি জেনেও মাঠে যারা

করোনায় ঝুঁকি জেনেও বরিশালে যারা মাঠে কাজ করছেন তাদের জন্য আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যারা যারা এই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন তাদের নিয়ে ভোরের আলোর বিশেষ আয়োজন। ধরাবাহিকভাবে আমরা ব্যক্তি, ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আমাদের আজকের বিষয় ‘ঝুঁকি জেনেও মাঠে যারা’ শিরোনামের প্রতিষ্ঠান হচ্ছে লাল-সবুজ সোসাইটি।
করোনার ঝুঁকিতে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। করোনা মোকাবেলায় এখনো সেরকম ব্যবস্থা নেই। কেবল জনসমাগম থেকে দূরে থাকা। সতর্ক ও সচেতনতা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। করোনা ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য সরকার থেকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ওই নির্দেশনা মানছেন অনেকেই। কিন্তু সবাই যদি ওই নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকে তাহলে কি করোনা মোকাবেলা সম্ভব হবে? হবে না। সবার নিরাপত্তায় কেউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতেই হবে। তাই কঠিন স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকার পরও এক শ্রেণির মানুষ মাঠে থেকে করোনা মেকাবেলায় কাজ করছেন।
যদিও এদের মধ্যে ভাগ রয়েছে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে মাঠে থাকছেন। সরকারের এবং প্রাতিষ্ঠানিক নির্দশনা অমান্য করার সুযোগ নেই বলে মাঠে থাকছেন। এদের মধ্যেও এক শ্রেণি আছেন তারা নির্দেশনার অপেক্ষা না করেই মাঠে ছিলেন এবং আছেন। এর বাইরে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় সহযোগী হয়ে মাঠে থাকছেন। তারপরও যে ভাবেই বলি না কেন করোনা ঝুঁকি মোকাবেলায় সবাই মাঠে থেকেই লড়াই করছেন।
এই লড়াইয়ে প্রথম সারিতে আছেন আমাদের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এরপর মাঠ প্রশাসনের মূল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ প্রশাসন। আছেন জনপ্রশাসন, সেনাবাহিনী, র্যাব, গণমাধ্যম, পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। এ ছাড়াও করোনা মোকাবেলায় অতি জরুরী পরিসেবার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত আছেন। আমার তাদের প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা যার যার অবস্থান থেকে ঝুঁকি জেনেও লড়াইয়ের মাঠে আছেন।
সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি ও সংগঠন স্বেচ্ছায় দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। করোনার এই মহামারীর ঝুঁকি জেনেও মাঠে কাজ করছেন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি স্বেচ্ছাসেবক। যারা স্বেচ্ছায় মানুষদের সচেতন করার জন্য মাঠে আছেন। আছেন কর্মহীন মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে, অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিয়ে, ত্রাণ ও খাবার নিয়ে। সচেতনতায় তারা কখনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করছেন, সড়ক ও দেয়ালচিত্র এঁকে সচেতন করছেন। এমন সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকে সাদুবাদ জানাতেই হয়। যারা কেবল দায় থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। কোন নির্দেশনার অপেক্ষা না করে ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। আমরা শ্রদ্ধাবনত তাদের কাছে। আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল তাদের প্রতি। নিজেদের ঝুঁকিতে রেখে তারা আমাদের রক্ষায় কাজ করছেন।
এরকম একটি সংগঠন লাল-সবুজ সোসাইটি। বাংলাদেশে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে জীবনকে তুচ্ছ করে মাঠে কাজ করছেন এই সংগঠনের কর্মীরা। তারা সাইকেল চালিয়ে বরিশালের এক পান্ত থেকে অন্য প্রন্ত ছুটে যাচ্ছেন। কখনো হ্যা- স্যানিটাইজার, কখনো মাস্ক, কখনো গ্লোভস হাতে। আবার কখনো দেয়াল চিত্র এঁকে নাগরিকদের সচেতন করছেন। কেবল কি তাই? প্রতিদিন খাবার রান্না করছেন এবং সেই রান্না খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন অসহায় মানুষদের কাছে। আবার কখনো খাবার নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন করোনা মোকাবেলার কারিগর ডাক্তারদের কাছে। নিজেদের ঝুঁকিকে পাত্তা না দিয়ে সবাইকে ঘরে থাকতে বলছেন।
‘সুসময় অনেকেই বন্ধুবটে হয়, অসময় হায় হায় কেউ কারো নয়’। সুসময় তো অনেককে পাশে পাবেন। দুঃসময়, দুর্যোগে তকজন পাশে থাকে। সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে করোনা। সেটা বোঝার সময় এখন। যখান অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা ঘরবন্দী হয়ে আছেন। করোনা ঝুঁকির কারণে তারা মানুষের পাশে থাকতে পারছেন না। সেই মুহূর্তে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীদের এই লড়াই আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের উজ্জীবীত করছে। লাল-সবুজ সোসাইটির যে সদস্যরা তাঁদের জীবনের ঝুঁকি জেনেও দিন-রাত স্বেচ্ছায় কাজ করে চলেছেন তাদের পাশে থাকা উচিত। যারা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মানুষের পাশে আছেন তারাই তো প্রকৃত মানুষ। এদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার।
এখন দুঃসময়। এই দুঃসময়ে ছেলেরাই মাঠে থেকে কাজ করতে সাহস পাচ্ছে না। অথচ এই দুঃসময়ে লাল-সবুজ সোসাইটির হয়ে কাজ করছে বেশ কিছু মেয়ে। এটা অবশ্যই আশার কথা। কেবল বরিশাল নয় রাজধানী ঢাকাসহ অনেক জেলা শহরে লাল-সবুজের কর্মীরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে। বরিশালে মোহনা, মৌ, উপমা, নুপুর ও সুমাইয়ার মতো মেয়েরা ঝুঁকি জেনেও কাজ করে চলেছে। আমরা যখন ঘরের কোনে থাকছি, সেই সময় এই মেয়েরা আমাদের সচেতন করতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। কারা ওদের সাহস যোগাচ্ছে? কোন বাবা-মা ওদের এরকম কাজে উৎসাহ দিচ্ছে। উৎসাহ দেওয়া সেইসব বাবা-মায়েদের শ্রদ্ধা জানাতে চাই। তারা অবশ্যই করোনার ঝুঁকি সম্পর্কে জানে। তারপরও জীবনের ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে প্রিয় সন্তানকে মানুষের সেবায় অনেকটা উৎসর্গ করেছেন। এরকম বাংলাদেশই তো আমরা দেখতে চাই। এদের হাত ধরে সুন্দর পৃথিবী অবশ্যই গড়ে উঠবে।
লাল-সবুজ সোসাইটির চালিকাশক্তি তাহসিনকে বলেছিলাম সতর্ক থেকে কাজ করো। উল্টো তাহসিন আমাকে বললো দাদা, আপনারা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। আপনাদের পিপিই দরকার। আপনার পত্রিকায় কতজন কাজ করে? আমি চেষ্টা করে দেখি আপনাদের জন্য পিপিই সংগ্রহ করা যায় কি না। একবার ভাবুন, নিজের কথা না ভেবে আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবছে এই কিশোর। আমরা মনে করি এই তাহসিনরাই মূলত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। আমি তাহসিনকে বলেছিলাম, ‘তাহসিন, যখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত পুলিশ, ডাক্তার, গণমাধ্যম এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একজনও পিপিইর বাইরে থাকবে, ততোদিন পিপিই পড়া সঠিক হবে না।’ আমরা মনে করি আমাদের আগে পিপিই দরকার পুলিশের। তারা ২৪ ঘন্টা মাঠে থাকে। তাদের পিপিই বলতে একটি মাস্ক। সেখানে আমি পিপিই পড়ে কি হবে। আমি একা পিপিই পড়ে করোনা মোকাবেলা করতে পারবো না।
আসুন, আমরা সবাই মিলে করোনা মোকাবেলায় কাজ করি। সামাজিক কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমদের এই লড়াইয়ে অংশিজন হতে হবে। কেবল আমি একা নিরাপদে থাকলে হবে না। আমাদের সবাইকে নিরাপদ রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। থাকতে হবে মানুষে একজন হয়ে।