দেড় সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিতে তরমুজের সর্বনাশ

দেড় সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিতে তরমুজের সর্বনাশ

 

দেড় সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে আধাপাকা তরমুজ পচে নষ্ট হওয়ায় বরগুনার আমতলী উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক চাষীর পথে বসার অবস্থা হয়েছে।

ধারদেনা এবং এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া চাষীরা চোঁখে মুখে এখন অন্ধকার দেখছেন। কিভাবে তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন। টানা বৃষ্টিতে তাদের স্বপ্নের সাথে ভেঙ্গে গেছে মেরুদন্ড। চাষীরা বলছেন এখন মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ নেই।

আমতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলায় চলতি বছর ৬ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ চাষ হয়েছে। গত বছর ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছির। গত বছর তরমুজের গাছ হলেও ফলন কম হওয়ায় তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। লোকসান কাটানোর জন্য এবছর কৃষকরা দ্বিগুন জমিতে আগাম তরমুজ চাষ করে। এবছর তরমুজ গাছ এবং ক্ষেতের ফসল দেখে কৃষকরা চোখে মুখে স্বপ্ন দেখেছিল গতবারের লোকশান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখবে। কিন্তু লাভ তো দুরের কথা বৃষ্টির পানিতে তমুজ ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় তাদের স্বপ্ন খান খান হয়ে এখন পথে বসেছে। কি ভাবে মহাজন এবং এনজিওর দেনার টাকা পরিশোধ করবেন সে চিন্তায় অস্থির। অনেক কৃষক বলেন, পাওনাদারদের টাকা দিতে না পারলে এখন তাদের বাড়ি ঘড় ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। 

এবছর আমতলী উপজেলায় ২ লক্ষ ৪০ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেত বলে জানায় কৃষি বিভাগ। টাকায় লক্ষ্যমাত্রা ধারা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। বেসরকারী জরিপে দেখা গেছে, উপজেলায়  সম্পূর্ন এবং আংশিক মিলে প্রায় ১ হাজারর হেক্টর তরমুজের ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সোমবার এবং মঙ্গলবার দুদিন বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে চাষীদের সাথে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। চাওড়া লোদা গ্রামের মোশারেফ গাজী। ধারদেনা এবং ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে বাড়ির পাশে ১২ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। সেখানে স্বামী- স্ত্রী এবং কর্মচারী রেখে কাজ করেছেন। ক্ষেতে তরমুজ দেখে এক বুক আশায় স্বপ্ন দেখেছেন তরমুজের লাভের টাকায় এইবার বুঝি তাদের অভাব দুর হবে। ক্ষেতের তরমুজও প্রায় পরিপক্ষ হয়ে এসছে। ১০ লক্ষ টাকার মত তরমুজ বিক্রির স্বপ্নও দেখেছিলেন।  বিক্রির আর মাত্র ২টি সপ্তাহ অপেক্ষা। কিন্তু বিধি বাম। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাতে ক্ষেত তলিয়ে পানি জমে গাছসহ তরমুজ ভাসতে থাকে। এ যেন মোশারেফ গাজীর স্বপ্নের যবনিকাপাত। দেড় সপ্তাহের বৃষ্টিতে গাছসহ তরমুজ পঁচতে পঁচতে মোশারেফ গাজীর স্বপ্ন যেন ধুলিসাৎ হয়ে যায়। চোঁখের সামনে ক্ষেতে ছড়ানো আড়াই লক্ষ টাকা পানিতে ভেসে যাওয়ায় নীরবে কেঁদেছেন অনেক। এখন ধারদেনা কিভাবে পরিশোধ করবেন সেই চিন্তায় বিভোর।

পার্শ্ববর্তী গলাচিপা উপজেলার নলুয়াবাগী গ্রামের হাসেম বিশ্বাসের দুই ছেলে কবির বিশ্বাস ও  আলমগীর বিশ্বাস আমতলীর কাউনিয়া গ্রামের ৪২ বিঘা জমি ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকায় জমি লিজ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন। সার ওষুধ কর্মচারীসহ তাদের খরচ হয়েছে ৭ লক্ষ টাকা। গাছ এবং ক্ষেতের ফসল দেখে ১৫ লক্ষ টাকা বিক্রির আশা করেছিলেন। কিন্ত বৃষ্টিতে তাদের সে আশা মাটিতে ধুলিৎসাত করে দিয়েছে। মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করে এখন শুধু পঁচে যাওয়া তরমুজ এবং ক্ষেতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কষ্টের ফসল চোঁখের সামনে বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন নির্বাক হয়ে গেছেন। আসল টাকা হারিয়ে এখন নিঃস্ব দুই ভাই। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন আর কি ভাবেই বা দেনা পরিশোধ করবেন সে চিন্তায় চোঁখের জল ফেলছেন।

এছাড়াও উপজেলার ভিন্ন গ্রাম ঘুরে বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হওয়া তরমুজ ক্ষেত দেখা গেছে। এদের মধ্যে উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের ঝন্টু মোল্লার ৯বিঘা, মন্নান মোল্লার ৪বিঘা, হলদিয়া গ্রামের বশির গাজীর ৫ বিঘা তরমুজ নষ্ট হয়েছে। মজনু প্যাদার ১২ বিঘা, জালাল হাওলাদারের ১২ বিঘা, পশ্চিম চিলা গ্রামের মনিরুল ইসলামের ৩ বিঘা, হলদিয়ার বাবুল মোল্লার ১৬ বিঘা, সোনাউটা গ্রামের সোহেল মোল্লার ২৪ বিঘা, সোনাউটা গ্রামের আনোয়ার সিকদারের ১৬বিঘা, বাইনবুনিয়া গ্রামের আলমগীর প্যাদার ৪বিঘা, আলামিন খানের ৬বিঘা, রাহাত মৃধার ৬বিঘা, মামুন প্যাদার ৪বিঘা তরমুজ বৃষ্টির পানি জমে আধাপাকা অবস্থায় গাছ শুকিয়ে ক্ষেতের সকল তরমুজ নষ্ট হয়েছে।

হলদিয়া গ্রামের ঝন্টু মোল্লা বলেন, সকল সম্বল শেষ করে এবং আত্মীয় স্বজনদের নিকট ধেকে ধারদেনা করে ৯ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে বৃষ্টির পানিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়া সকল তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পথে বসা ছাড়া কোন উপায় নেই।

সোনাউটা গ্রামের সোহেল মোল্লা বলেন, ২৪ বিঘা জমির সকল তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ব্যাংক ও এনজিওর ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবো সেই চিন্তায় অস্থির আছি। টাকা দিতে না পারলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে।

ঋণদান কারী এনজিও সংগ্রাম এর আমতলীর ম্যানেজার বেবী দত্ত জানান, এবছর তরমুজ চাষের জন্য আমতলী উপজেলার ২৮৫ জন কৃষকের মধ্যে ১ কোটি ১০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অনেক চাষীর ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় এখন কিস্তি উঠানো নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি।

আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিএম রেজাউল করিম বলেন, এ বছর অসময়ে বৃষ্টি পাতের ফলে তরমুজ চাষীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সরকারীভাবে ৫০ হেক্টর জমির তরমুজ সম্পূর্ন নষ্ট হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।