নারী দিবসে নারীর অধিকার-প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত হোক

নারী দিবসে নারীর অধিকার-প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত হোক

নারীর অজর্ন আর ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রেরণা। নারী দিবসে নানামুখী আয়োজনে ভিন্ন মত থাকলেও উদযাপনের উপলক্ষ্য হতেই পারে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, ক্ষমতায়ন, প্রতিষ্ঠা প্রতিটি অর্জনের ভিত্তি নারীর সুস্বাস্থ্য। প্রতিটি সুস্থ ও বিকাশশীল সমাজ  তৈরীর প্রাথমিক কারিগর নারী। তাই সবসময়ের অবহেলিত নারীর নারী স্বাস্থ্যের সুস্থতা জরুরি আগামী ভবিষ্যতের জন্য। ৮ মার্চ নারী দিবসে নারীর অধিকার-প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত হওয়ার দাবি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

জন্ম থেকেই ভবিষ্যৎ মাতৃসত্বা লুকিয়ে থাকা নারী প্রতিদিন বেড়ে ওঠে আর ধীরে ধীরে পুষ্ট হতে থাকে। একটি ভ্রুণ থেকে মানব জন্ম নেয়ার যে যাত্রা এবং তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে একজন নারীর প্রস্তুতি খানিকটা অবহেলায় প্রাকৃতিক নিয়মের বেড়াজালে জীবনের কর্তব্য বলেই বিবেচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে; শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক দিকে সম্পূর্ণ ভালো থাকাকে বোঝায়। নারী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিকার নিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনেক কাজ হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে নানা সূচকে রোল মডেল মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অপেক্ষমান থাকা বাংলাদেশ। বাল্যবিবাহের হার হ্রাস পাওয়ায় মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় এ অর্জন।

এদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তবে  করোনা মহামারীর মধ্যে এদেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারনে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ  এবং করোনা মহামারী দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে লকডাউনে  ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়াও বাল্যবিবাহের কারণ।

২০২০ সালে অক্টোবরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাসে (মার্চ-জুন২০২০) সারাদেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে গত জুন মাসে ৪৬২টি কন্যা শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয় এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের আন্তরিক সক্রিয় উদ্যেগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, আর বাল্যবিবাহের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারীর কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি ও কমিউনেশন হেড মনজুন নাহার বলেন, বিভিন্ন  তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। উপর্যুপরি, ইতিহাস বলে যে, এই ধরণের অবস্থার পরপরই গর্ভধারণ, বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা এবং অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। তাই সঙ্গত কারণেই মহামারীর প্রথম থেকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মেরী স্টোপস বাংলাদেশের কাজ ছিলো নিরাপদ মাতৃত্ব, সন্তান ধারণ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার এবং এই সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মসূচি এবং তথ্যসেবাসমূহ নিশ্চিত করা।

আজকের কিশোর কিশোরীরাই আগামীতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবিরের মতে ১৫ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, মানসিক শক্তি অর্জন, সাবলম্বী হওয়ার প্রস্তুতি এসকল কিছুর ভীত তৈরি হয় এই বয়সেই।
সরকারের ন্যাশনাল পলিসি অন আ্যডোলেসেন্ট হেলথ অনুসারে কিছু স্কুলে কিশোর কিশোরী স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ে ৬০৩টি স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য উপকরণসহ কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির কারিগর। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বিদ্যালয়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব এবং পারিবারিকভাবে প্রয়োজনীয় ধারণা না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারণার জন্ম নেয়। আর তা থেকেই ভুল হয়, জীবনের ছন্দ হারায়। কৈশোরে হঠাৎ পরিবর্তন আসা বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে প্রত্যেক কিশোর কিশোরীর স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী। 

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, ‘প্রতিটি পরিবার যদি মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়গুলোকে উত্থাপন করে, সবাইকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তাহলে সারা দেশে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জায়গা তৈরি করা সম্ভব’। তাই প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার গুরুত্ব বুঝে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সরকার এবং সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে আগামীর সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়।